Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

গণধর্ষণের মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকির অভিযোগ গাইঘাটায়

মামলার শুনানি শুরুর আগেই গণধর্ষণে অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে ক্রমাগত মামলা প্রত্যাহারের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠল। বিপুল অঙ্কের টাকার টোপ দেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি নির্যাতিতার পরিবারের।

নিজস্ব সংবাদদাতা
গাইঘাটা শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৪ ০২:২৫
Share: Save:

মামলার শুনানি শুরুর আগেই গণধর্ষণে অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে ক্রমাগত মামলা প্রত্যাহারের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠল। বিপুল অঙ্কের টাকার টোপ দেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি নির্যাতিতার পরিবারের। এই মর্মেই মেয়েটির বাবা সোমবার বনগাঁর এসডিপিও-র কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। বুধবার থেকে মামলাটির শুনানি বনগাঁ মহকুমা আদালতে শুরু হওয়ার কথা।

বনগাঁ আদালতের মুখ্য সরকারি আইনজীবী সমীর দাস বলেন, “ইতিমধ্যেই ওই মামলার চার্জ গঠন করা হয়েছে। বুধবার থেকে সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে শুনানি শুরু হবে। ওই দিন নির্যাতিতার সাক্ষ্য নেওয়া হবে। ছাত্রীর বাবা আমাদের কাছেও তাঁকে হুমকি দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। এসডিপিওকে বলেছি বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে।” বুধবার মেয়েটিকে পুলিশি প্রহরায় আদালতে আনা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই পরিবারের নিরাপত্তার জন্য ইতিমধ্যেই পদক্ষেপ করা হয়েছে। মেয়েটির বাবার এরপরেও যদি কোনও বক্তব্য থাকে, তার প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।’’

গত ১০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় গাইঘাটা থানার ঠাকুরনগর এলাকার শিমুলপুরের বাসিন্দা বছর উনিশের ওই ছাত্রীকে তাঁর বাবা ফোন করে বই কিনে দেওয়ার জন্য বাজারে ডাকেন। ফোন পেয়ে তরুণী ঠাকুরনগর বাজারে যান। অভিযোগ, বই কিনে বাড়ি ফেরার পথে জিকো কীর্তনিয়া ও বলরাম মাতা নামে দুই যুবক তাঁকে মুখ চেপে ধরে বাইকে একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। সেখানে আগে থেকেই রাজ গোমস নামে অন্য এক যুবক উপস্থিত ছিল। সে-ও ধর্ষণ করে। মেয়েটির নগ্ন শরীরের ছবি মোবাইলে তোলা হয়। ঘটনার কথা জানাজানি হলে ওই ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে মেয়েটিকে তারা ভয় দেখায় বলেও অভিযোগ ওই ছাত্রীর। রাত ১১টা নাগাদ মেয়েটিকে বাড়ির কাছে ফেলে রেখে যায় ওই যুবকেরা।

পরদিন মেয়েটিক তিন জনের বিরুদ্ধে গাইঘাটা থানায় অভিযোগ দায়ের করে। পুলিশ সকলকেই গ্রেফতার করে। তারা এখন জেল-হাজতে। ঘটনার পরপরেই সুবিচারের আশ্বাস দিয়ে পরিবারটির পাশে দাঁড়িয়েছিল রাজ্যের শাসক দল। মেয়েটির বাড়িতে আসেন রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, তত্‌কালীন বনগাঁর সাংসদ গোবিন্দচন্দ্র নস্কর, গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ধ্যানেশ নারায়ণ গুহ। বামেদের এক প্রতিনিধি দলকে ওই ছাত্রীর বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চের প্রতিনিধিরা ও বনগাঁ আদালতের আইনজীবীদের একটি দল-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা নির্যাাতিতার পাশে এসে দাঁড়ান। মেয়েটির স্কুলে গাইঘাটা থানার পক্ষ থেকে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক ও জন প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

ঘটনার পর থেকেই বছর উনিশের তরুণী কার্যত ঘর-বন্দি হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁর ভাই ও মা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরোন না। এরই মধ্যে অবশ্য গাইঘাটা থানার ওসি অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তিনি ফের লেখাপড়া শুরু করেছেন। শনিবার থেকে পুলিশি পাহারায় ফের স্কুলেও যাচ্ছেন। পুলিশ জানিয়েছে, ওই পরিবারের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে বাড়িতে সর্ব ক্ষণ পুলিশি পাহারা রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির উঠোনে একটি কাঠের খাট ও একটি টেবিল। উপরে একটি কালো পলিথিন টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে দু’জন মহিলা পুলিশ কনস্টেবল ও দু’জন সিভিক পুলিশ কর্মী রয়েছেন।

মেয়েটির বাবা বলেন, ‘‘রাস্তায় বেরোলেই ফোন করে বা ডেকে নিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। কখনও বলা হচ্ছে এলাকা ছাড়া করা হবে। কখনও আসছে খুনের হুমকি। মামলা তুলে নিলে ২-১৮ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।’’ তাঁর দাবি, ‘‘ঘটনার সময় যে সব তৃণমূল নেতা পাশে ছিলেন, তাঁরা আজ কেউ পাশে নেই। যারা হুমকি দিচ্ছে তারাও তৃণমূল করে।’’ এসডিপিও-র কাছে করা লিখিত অভিযোগে তিনি অবশ্য কোনও নাম উল্লেখ করেননি। ধ্যানেশবাবু বলেন, ‘‘আমরাই প্রথমে পরিবারটির পাশে ছিলাম। কিন্তু ওঁদের ব্যবহারে সরে এসেছি। ওঁরা আমাদের কাছে আসেন না। এলে সহযোগিতা করা হবে।’’ তৃণমূলের হুমকির বিষয়ে ধ্যানেশবাবুর বক্তব্য, ‘‘ওই ব্যক্তি নির্দিষ্ট করে কেন কারও নামে থানায় অভিযোগ করছেন না। করলে দলের কেউ সত্যিই যুক্ত আছে কিনা বোঝা যেত। সেই মতো ব্যবস্থাও নিতে পারতাম।”

তরুণী বলেন, ‘‘বাবাকে নিয়েই আমার চিন্তা। আমি বাড়িতে পুলিশি পাহারায় থাকি, কিন্তু বাবাকে তো কাজের জন্য একা বাইরে যেতেই হয়। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই আমি সরে আসব না। ওদের কঠোর শাস্তি চাই।’’ নির্যাতিতার বাবা অন্যের জমিতে ভাগে চাষ করেন। বাড়িটিও নিজেদের নয়। এক আত্মীয়ের বাড়িতে ভাড়া থাকেন ওঁরা। খাদ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে তাঁর স্ত্রী শুধুমাত্র একটি অন্ত্যোদয় যোজনার কার্ড ছাড়া আর কিছুই পাননি। অভাবের সংসার। তবু নির্যাতিতার বাবা বলছেন, ‘‘পেট ভরে খেতে পাই বা না পাই, এমনকী জীবন চলে গেলেও মামলা তুলব না। তা সে ১৮ কোটি টাকা দিলেও না।’’ চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তাঁর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE