তিন দিন ধরে খোঁজ মেলেনি ঘরের মানুষের। মঙ্গলবার রাতে যখন ট্রলার থেকে এক এক করে বের করা হচ্ছে জালে জড়িয়ে যাওয়া মৃতদেহগুলি, মুখ চিনেই কান্নায় ভেঙে পড়ে পরিবারগুলো। এর চেয়ে হয় তো নিখোঁজ থাকাই ভাল ছিল!
গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে নিখোঁজ হওয়া ‘এফবি সূর্যনারায়ণ’ ট্রলারের হদিস মিলেছিল মঙ্গলবার। ট্রলারের মধ্যে থেকেই উদ্ধার হয় ৬ মৎস্যজীবীর দেহ। ‘এফবি কৃষ্ণনারায়ণ’, ‘এফবি বনদুর্গা’, ‘এফবি বিজয়নারায়ণ’, ‘এফবি নারায়ণ’, ‘এফবি সত্যনারায়ণ’ ও ‘এফবি রূপনারায়ণ’ ও ‘এফবি অন্নপূর্ণা’ নামে মৎস্যজীবীদের ৭টি ট্রলার প্রায় ১০ ঘণ্টার চেষ্টায় নামখানার হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদীপথ ধরে ঈশ্বরীপুর গ্রামের কাছে ট্রলারটিকে পাড়ে নিয়ে আসে। ঘণ্টা তিনেকের চেষ্টায় উল্টে যাওয়া ট্রলারটিকে সোজা করা যায়। রাতে কাজের জন্য ব্যবস্থা করা হয় জেনারেটরের। জালের মধ্যে থেকে মেলে দক্ষিণ পুকুরবেড়িয়া গ্রামের কালীপদ দাস (৪৫), সূর্য দাস (৪৫) ও পশ্চিম গঙ্গাধরপুরের লোটন দাস (২০), রাখাল দাস (২০), অভিরাম দাস (২৬), সুরেশ দাসদের (৪৫) নিথর দেহ। তবে এখনও যোগেশ দাস নামে ওই ট্রলারেরই এক মৎস্যজীবীর খোঁজ মেলেনি। দেহগুলি সনাক্তকরণের পরে রাতেই ডায়মন্ড হারবার মহকুমা হাসপাতালে ময়না-তদন্তের জন্য পাঠানো হয়। পুরো উদ্ধার কাজের তদারকিতে ছিলেন মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ ও সুন্দরবন উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা। ‘এফবি মহারুদ্র’ ট্রলারটিকেও কাছি দিয়ে টেনে আনা হয় কাকদ্বীপ মৎস্যবন্দরে।
দিন কয়েক আগে কাকদ্বীপ মৎস্যবন্দর থেকে ১৫ জন মৎস্যজীবীকে নিয়ে বেরিয়েছিল সূর্যনারায়ণ। নামখানা ঘাট থেকে মহারুদ্র ট্রলারে বেরোন ১৪ জন মৎস্যজীবীর আর একটি দল। রবিবার গভীর সমুদ্রে ঝড়ে ঢেউয়ের ধাক্কায় ট্রলার দু’টি উল্টে যায়। কাছে থাকা অন্য কয়েকটি ট্রলার এগিয়ে এসে কয়েক জনকে উদ্ধার করে। কিন্তু খোঁজ মেলেনি মহারুদ্র ট্রলারের ৭ জনের। নিখোঁজ মৎস্যজীবীদের সন্ধানে কাকদ্বীপ মৎস্যজীবী উন্নয়ন সমিতির উদ্যোগে সোমবার ৭টি ট্রলার গভীর সমুদ্রে পাঠানো হয়। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় সেগুলি জম্বুদ্বীপের কাছে অপেক্ষা করছিল। মঙ্গলবার আবহাওয়ার উন্নতি হলে ট্রলারগুলি বেরিয়ে পড়ে। এ দিন সকাল ৭টা নাগাদ জম্বুদ্বীপ থেকে বেশ কিছুটা দূরে ‘সূর্যনারায়ণ’-এর খোঁজ মেলে।
এ দিন দক্ষিণ পুকুরবেড়িয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ভেঙে পড়েছেন মৃতদের পরিবার। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারীর মৃত্যুতে সন্তানদের নিয়ে পথে বসার অবস্থা তাঁদের। সরকার থেকে দুর্ঘটনায় মৃত মৎস্যজীবীদের পরিবারগুলিকে ১ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা যৎসামান্য বলে জানিয়েছেন পরিবারগুলির সদস্যেরা। সূর্য দাসের স্ত্রী শ্রাবণী দেবী ও কালীপদ দাসের স্ত্রী লক্ষ্মণা দাসদের অভিযোগ, দুর্ঘটনার সময়ে অনেক নেতা-মন্ত্রীদেরই দেখা যায়। তারপর আর কাউকে দেখা যায় না। বড় রকম আর্থিক ক্ষতিপূরণ দরকার। মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ জানান, আপাতত ওই পরিবারগুলিকে সরকারি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। পরে অন্য কী ব্যবস্থা করা যায়, দেখা যাবে।
স্বজন হারিয়ে...
• প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া যায় না।
• লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বোটের ব্যবস্থা নেই।
• আপৎকালীন চিকিৎসারও কোনও ব্যবস্থা নেই।
• ট্রলার-চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না।
• দিগনির্ণয়েরও কোনও ব্যবস্থা নেই।
৮ নম্বর কালীনগর মাইতির চকের বাসিন্দা বাদল দাস, উজ্জ্বল দাসেরা বলেন, পরিকাঠামোর অভাবে আগে থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বোটের ব্যবস্থা নেই। আপৎকালীন চিকিৎসারও কোনও ব্যবস্থা নেই। হাজার হাজার ট্রলার গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়, অথচ ট্রলার-চালকদের কোনও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। দিগনির্ণয়েরও কোনও ব্যবস্থা নেই।
তাঁরা জানাচ্ছেন, বেশিরভাগ সময়েই গভীর সমুদ্রে চরে ধাক্কা খেয়ে ট্রলার উল্টে যায়। সে ক্ষেত্রে সরকারের উচিত, সমুদ্রের কোথায় চর রয়েছে, তা আগে থেকে চিহ্নিত করে দেওয়া। উজ্জ্বল শীল নামে এক মৎস্যজীবীর বক্তব্য, “বহু বার এ ভাবে বিপদে পড়েছি। সরকার আগাম কিছু ব্যবস্থা নিলে এই সমস্যা কিছুটা কমবে।” মৎস্যজীবী উন্নয়ন সমিতির সভাপতি বলেন, “মৎস্যজীবীদের সমস্যা নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। বিষয়টি নিয়ে আবার সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন করব।” তবে পরিকাঠামোর বিষয়ে চন্দ্রনাথবাবুর বক্তব্য, “ধীরে ধীরে পরিকাঠামো ব্যবস্থার উন্নতির চেষ্টা করা হচ্ছে।”