Advertisement
০৩ মে ২০২৪

টর্চের আলো লক্ষ্য করেই উড়ে এসেছিল গুলি

গরু পাচারকারীদের দেখার জন্য টর্চ জ্বেলেছিলেন রাশিকুল ইসলাম। সঙ্গে সঙ্গে একটি বুলেট এসে লাগে তাঁর ডান চোখের উপরে। বৃহস্পতিবার ভোরে স্বরূপনগর সীমান্তে ওই একটি গুলিতেই প্রাণ হারান বছর বাইশের তরতাজা জওয়ান রাশিকুল। বিএসএফের একটি সূত্র এই তথ্য জানিয়েছে। বিএসএফের দাবি, রাশিকুলের সহকর্মীদের পাল্টা গুলিতে জখম হয় পাচারকারীদের চার-পাঁচ জন। কয়েকশো পাচারকারী অবশ্য তাদের নিয়ে পালিয়ে যায় সীমান্তের ও পারে।

সশস্ত্র পাচারকারীদের মোকাবিলায় বহু জওয়ানের ভরসা এই বাঁশের চটা আর লাঠি।—নিজস্ব চিত্র।

সশস্ত্র পাচারকারীদের মোকাবিলায় বহু জওয়ানের ভরসা এই বাঁশের চটা আর লাঠি।—নিজস্ব চিত্র।

নির্মল বসু
স্বরূপনগর শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:৫২
Share: Save:

গরু পাচারকারীদের দেখার জন্য টর্চ জ্বেলেছিলেন রাশিকুল ইসলাম। সঙ্গে সঙ্গে একটি বুলেট এসে লাগে তাঁর ডান চোখের উপরে। বৃহস্পতিবার ভোরে স্বরূপনগর সীমান্তে ওই একটি গুলিতেই প্রাণ হারান বছর বাইশের তরতাজা জওয়ান রাশিকুল।

বিএসএফের একটি সূত্র এই তথ্য জানিয়েছে। বিএসএফের দাবি, রাশিকুলের সহকর্মীদের পাল্টা গুলিতে জখম হয় পাচারকারীদের চার-পাঁচ জন। কয়েকশো পাচারকারী অবশ্য তাদের নিয়ে পালিয়ে যায় সীমান্তের ও পারে। কিছু গরু আটক করে বিএসএফ। কিন্তু এই তথ্য অন্য ভাবে ভাবাচ্ছে বিএসএফ এবং গোয়েন্দাদের। গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের মতে, পাচারকারীদের গুলি ছোড়ার ধরন দেখে অনুমান করা হচ্ছে, প্রশিক্ষিত বন্দুকবাজেরাই গুলি চালিয়েছিল। যে কারণে টর্চের আলোর সূত্র ধরে একটি মাত্র গুলি এসে লাগে রাশিকুলের মাথায়। গরু পাচারকারীদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র থাকেই। কিন্তু কুয়াশা ঘেরা অন্ধকারে এমন অব্যর্থ নিশানা দেখে গোয়েন্দাদের একাংশের অনুমান, পাচারকারীদের দলে কোনও জামাত জঙ্গি লুকিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে ঢুকে পড়তে পারে। কী ধরনের বুলেট লেগেছিল রাশিকুলের শরীরে, তা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

বস্তুত, খাগড়াগড় কাণ্ডে এনএআইএ তদন্তভার নেওয়ার পর থেকে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ধরপাকড়, তল্লাশি বেড়েছে। ফলে সন্দেহভাজন অনেকেই গত কয়েক মাসে গা ঢাকা দিতে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়েছে। তাদের মধ্যে জামাত জঙ্গিরাও থাকতে পারে বলে বিএসএফ এবং গোয়েন্দাদের একাংশ মনে করছেন। সম্প্রতি আবার রাজনৈতিক সন্ত্রাসে ফের উত্তপ্ত পড়শি দেশের পরিবেশ। জামাতের লোকজনকে ধরপাকড় করছে সে দেশের পুলিশ ও গোয়েন্দারা। খোদ বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া কার্যত গৃহবন্দি হয়ে আছেন। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশেও বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিএনপি ঘনিষ্ঠ জামাতের লোকজন সীমান্তের এ পাড়ে এসে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে বলেও আশঙ্কা গোয়েন্দাদের। সে ক্ষেত্রে গরু পাচারকারীদের দলে ভিড়ে গিয়ে সীমান্তের এ পার ও পার করা তাদের কাছে সুবিধাজনক মনে হতে পারে। পাচারকারীরা সংখ্যায় অনেক বেশি থাকে। তাদের হাতে অস্ত্র থাকে। বিএসএফের চোখে ধুলো দিয়ে তারা নিয়মিত পারাপার করে। ফলে ওই দলের মধ্যে মিশে থাকলে নিরাপত্তা বেশি। বিচ্ছিন্ন ভাবে সামীন্ত পেরোতে সমস্যা হতে পারে। ধরপাকড়ের আশঙ্কাও থাকে। স্বরূপনগরের সীমান্তে গরু পাচারকারীদের ওই দলে অস্ত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গিরা ছিল কিনা, তা এখন ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের। তা না হলে ঘন কুয়াশার মধ্যে কেবলমাত্র টর্চের আলো লক্ষ্য করে একটি মাত্র বুলেট কী ভাবে প্রাণ নিল রাশিকুলের? এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন বিএসএফ কর্তাদের একাংশও।

গরু পাচারকারীদের তাণ্ডবে এমনিতেই অতিষ্ঠ সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষ জন। গরুর পায়ের চাপে ফসল নষ্ট হয়। তা ছাড়া, সীমান্তের গ্রামে ঢুকে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা ডাকাতি, লুঠপাট, মারধরের ঘটনা হামেশাই ঘটায়। মাঝে মধ্যে ধরপাকড় করলেও বিএসএফও কার্যত বহু ক্ষেত্রে অসহায়। একে তো তাদের উপরে গুলি চালানোয় নানা নিষেধাজ্ঞা আছে। যে কারণে গত কয়েক বছরে বিএসএফের গুলিতে সন্দেহভাজন পাচারকারীর মৃত্যুর ঘটনা উত্তর ২৪ পরগনায় প্রায় ঘটেনি বললেই চলে। তার উপরে, সীমান্তের অধিকাংশ জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া নেই। উন্মুক্ত সীমান্তে হাতে গোনা কয়েক জন জওয়ানকে টেক্কা দেওয়া শ’য়ে শ’য়ে বাংলাদেশি পাচারকারীর পক্ষে খুব একটা বড় সমস্যা হয় না।

এই নিয়ে গত কয়েক বছরে স্বরূপনগর সীমান্তে তিন জন জওয়ান পাচারকারীদের আক্রমণে প্রাণ হারালেন। তবে খুব সম্প্রতি এমন ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশে উদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যেই বৃহস্পতিবারের ঘটনায় সে কারণেই বাড়তি তাৎপর্য থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ সীমান্তকে অতীতেও নানা ভাবে ব্যবহার করেছে জঙ্গিরা। কন্দাহার বিমান ছিনতাই কাণ্ডের অন্যতম চক্রী বেলালকে শাঁকচুড়ো সীমান্ত থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। খাদিম কর্তা পার্থ রায়বর্মণ অপহরণ কাণ্ডে মুক্তিপণের টাকা বসিরহাট সীমান্ত হয়েই জঙ্গিদের হাতে পৌঁছেছিল। সম্প্রতি স্বরূপনগর সীমান্তে কোটি কোটি টাকার সোনার বিস্কুট উদ্ধার করেছে বিএসএফ। গরু পাচারের ক্ষেত্রে টাকার বদলে ইদানীং সোনার বিস্কুটের চল বেড়েছে বলেও জানাচ্ছেন গোয়েন্দারা। সব মিলিয়ে সীমান্ত এলাকায় আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা থেকেই গিয়েছে।

বসিরহাট মহকুমার সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষজনের বক্তব্য, গরু পাচারই যেখানে মূল সমস্যা, সেখানে কেন কড়া হচ্ছে না পুলিশ-প্রশাসন, রাজনৈতিক দলগুলি? পাচারের জন্য গরু আনা হয় মূলত উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার থেকে। সেই গরু হুগলি জেলার পাণ্ডুয়া হয়ে চলে আসে বাংলাদেশ সীমান্তে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যে গরু আসছে, তাকে কেন অন্যত্র আটকে দেওয়া হচ্ছে না, সে প্রশ্নের উত্তর জানেন না মানুষ। কেনই বা রাতের অন্ধকারে বিএসএফকে নাইট ভিশন ক্যামেরা ব্যবহার করে গরু খুঁজতে হবে, তা নিয়েও কোনও উত্তর নেই তাঁদের কাছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

southbengal nirmal basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE