Advertisement
E-Paper

পড়ুয়ার সংখ্যা কমছে বসিরহাটের সরকারি প্রাথমিক স্কুলে

ছাত্র সংখ্যা কোথাও ৩, কোথাও ৫ আবার কোথাও মেরেকেটে ১৪-৩১ জন। এমন সাতটি স্কুলের মোট ১২৮ জন ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার দায়িত্বে আছেন ১৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। ভগ্নপ্রায় একটি স্কুল বাড়ির ৫ জন পড়ুয়ার জন্য ৪ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন, এমন উদাহরণও আছে। কোথাও আবার বিদ্যুৎ, পানীয় জল ছাড়াই চলছে স্কুল। সেখানে ৩ জন ছাত্রের জন্য আছেন দু’জন শিক্ষক। এদেরকে একত্রিত করে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে কোথাও কোথাও।

নির্মল বসু

শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৪ ০২:০৫
বন্ধ সাঁইপালা গার্লস স্কুলের জরাজীর্ণ ঘর।

বন্ধ সাঁইপালা গার্লস স্কুলের জরাজীর্ণ ঘর।

ছাত্র সংখ্যা কোথাও ৩, কোথাও ৫ আবার কোথাও মেরেকেটে ১৪-৩১ জন। এমন সাতটি স্কুলের মোট ১২৮ জন ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার দায়িত্বে আছেন ১৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। ভগ্নপ্রায় একটি স্কুল বাড়ির ৫ জন পড়ুয়ার জন্য ৪ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন, এমন উদাহরণও আছে। কোথাও আবার বিদ্যুৎ, পানীয় জল ছাড়াই চলছে স্কুল। সেখানে ৩ জন ছাত্রের জন্য আছেন দু’জন শিক্ষক। এদেরকে একত্রিত করে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে কোথাও কোথাও। কিন্তু সব মিলিয়ে বসিরহাট পুর এলাকার এই সব প্রাথমিক স্কুলে পড়াশোনার মান যে কী, তা সহজেই বোধগম্য। বসিরহাট পুরসভার ২২টি ওয়ার্ডের মধ্যে পূর্ব চক্রের অধীনে ৫৬টি প্রাথমিক স্কুলের একটা বড় অংশের স্কুল ঘর থাকলেও ছাত্রছাত্রীর অভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

বসিরহাট পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে জোড়াপুকুর ধারে কাছাকাছি দু’টি স্কুলের একটি সাঁইপালা গার্লস। অন্যটি নেতাজি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রথমটিতে ছাত্র সংখ্যা ছিল ৫ জন। দ্বিতীয়টিতে ৩ জন। তা-ও আবার অধিকাংশ দিন ছাত্রছাত্রীরা কেউ স্কুলে আসে না। গড়িয়ে গড়িয়ে সময় কাটত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। গত কয়েক বছর ধরে সাঁইপালা গার্লসের টালির চালের ঘরের দশা বেশ ভাঙাচোরা। এই পরিস্থিতিতে ছেলেমেয়েদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে ক্লাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এখানে। সেখানকার পড়ুয়ারা বর্তমানে নেতাজি প্রাথমিক স্কুলে ক্লাস করায় ছাত্র সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮ জন। দু’টি স্কুল একত্রিত করায় শিক্ষক আছেন ৬ জন।

টিম টিম করে ক্লাস চলছে নেতাজি প্রাথমিকে।

পুর এলাকার প্রাথমিক স্কুলগুলির মধ্যে ছাত্র সংখ্যা ৫০-এরও কম এমন স্কুলের সংখ্যা ১০টি। একশোর নীচে পড়ুয়া আছে ২০টি স্কুলে। দু’শোর মধ্যে ছাত্র আছে ১৫টিতে। দু’শোর উপরে ছাত্র আছে এমন স্কুলের সংখ্যা মাত্র ৯টি। সাঁইপালা প্রাথমিক স্কুলে সব থেকে বেশি ১৮ জন শিক্ষক-শিক্ষাকার তত্ত্বাবধানে ৮৮৫ ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করে। মহকুমা স্কুলশিক্ষা দফতরের দাবি, বসিরহাট পূর্ব চক্রের অধীনে ৫৬টি প্রাথমিক স্কুলে বর্তমানে মোট ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৬৯৪৪। স্থায়ী ও পার্শ্ব শিক্ষক মিলিয়ে আছেন ২৬২ জন। খর্দবালিয়া কে বি ইউ পি স্কুলে ১৪ জন ছাত্র। সেখানে ২ জন শিক্ষক। বসিরহাট জি এস এফ পি ছাত্র সংখ্যা ২২ জন। শিক্ষক ২ জন। শ্রী শ্রী সারদেশ্বরী অবৈতনিকে পড়ে ২৬ জন ছাত্র। এখানে দায়িত্বে আছেন ২ জন শিক্ষক। ক্ষেত্রনাথ প্রাইমারিতে আবার ৩১ জন ছাত্রের জন্য আছেন মাত্র ১ জন শিক্ষক।

সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলির যখন এই অবস্থা, সেখানে শহরের এক একটি বেসরকারি স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা কোথাও হাজারের কাছাকাছি। কোথাও আবার তার থেকেও বেশি। ২০-২৫ জনের নীচে শিক্ষক নেই।

তা হলে সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলির এমন হাল কেন?

পরিকাঠামো এখানে একটা বড় তফাত করে দিচ্ছে বলে মনে করেন অভিভাবকদের একাংশ। মান্ধাতার আমলের একটি মাত্র ঘরে আলো-পাখা ছাড়া স্কুলে ছেলেমেয়েদের পাঠাতে চান না তাঁরা। সামান্য আর্থিক সঙ্গতি থাকলেও পড়াশোনার জন্য তাঁরা বেছে নেন বেসরকারি স্কুলগুলিকে। কমল ভট্টাচার্য, রতন মণ্ডল, কমলিকা বসুরা বলেন, ‘‘বেসরকারি স্কুলের পরিকাঠামো ভাল। আরও অনেক সুবিধা আছে। বিপরীতে, সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলির অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।” তাঁদের মতে, সরকারি স্কুলে কেবল শিক্ষক বাড়ালেই চলবে না, সেই সঙ্গে যাতে স্কুলগুলির পরিকাঠামোর আধুনিকীকরণ করা যায়, তা দেখাও জরুরি।

সাঁইপালা গার্লসে গিয়ে গেল, স্কুলের মধ্যে টেবিল-চেয়ার থাকলেও ইটের গাঁথনির উপর টালির চালের একটা অংশ ভেঙে পড়েছে। দীর্ঘ মেরামতির অভাবে গাঁথনির অবস্থা নড়বড়ে। একটু জোরে বাতাস বইলে যে কোনও মুহূর্তে ঘর ভেঙে পড়তে পারে। ওই স্কুল-লাগোয়া বাড়ির বাসিন্দা প্রিয়া ভট্টাচার্য, উত্তম ঘোষালরা জানালেন, এক সময়ে খুব ভাল ছিল এই স্কুল। তাঁরা নিজেরাও এখানে পড়েছেন। স্থানীয় পরিবারের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই এক সময়ে এখানেই পড়েছে। শতাধিক পড়ুয়া এক সময়ে পড়ত এই স্কুলে। গমগম করত গোটা এলাকা। একদিন শোনা গেল, নড়বড়ে স্কুলবাড়ির জন্য ক্লাস বন্ধ করা হচ্ছে। এখানকার ছেলেমেয়েদের পড়তে যেতে হবে নেতাজি প্রাথমিকে। তাঁদের আক্ষেপ, “এলাকার মানুষ দাবি জানালেও বছর তিনেক আগে বন্ধ হওয়ার পরে এখনও খুলল না স্কুল।’’

নেতাজি প্রাথমিকে গিয়ে আবার দেখা গেল, চার জন শিক্ষক চার জন ছাত্রকে পড়াচ্ছেন। পড়াশোনা কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা নমিতা সরকার বললেন, ‘‘এ ভাবে কি পড়ুয়াবিহীন ক্লাস করা যায়! পড়ুয়ার খোঁজে বাড়ি বাড়ি যেতে হচ্ছে।” তিনি জানালেন, স্কুলে একটা মাত্র ঘর। দীর্ঘদিন যাবৎ একজন মাত্র শিক্ষক ছিলেন। পরে নতুন নতুন শিক্ষক আসেন ঠিকই, কিন্তু তত দিনে প্রচার হয়ে গিয়েছে, পড়াশোনা হয় না এখানে। ফলে নতুন করে কেউ ভর্তি হতে চাইছে না। বেসরকারি স্কুলগুলির পরিকাঠামোর সঙ্গেও সরকারি প্রাথমিক স্কুল পাল্লা দিতে পারছে না। আড়াইশো থেকে কমে কমে পড়ুয়ার সংখ্যা বর্তমানে এই ক’জনে এসে ঠেকেছে। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা নগণ্য হওয়ায় অন্যত্র মিড ডে মিল রান্না করে স্কুলে আনা হয় বলেও জানান নমিতাদেবী। গত ২০১১ সালে তাঁদের স্কুলটি নেতাজি প্রাথমিকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বলে জানালেন সাঁইপালা প্রাথমিক স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ভাস্কর দে। বললেন, ‘‘জমি-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে জটিলতার কারণে স্কুলঘর মেরামত হচ্ছে না। যে কোনও সময়ে তা ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া পড়ুয়ার অভাবও আছে। সে কারণেই দু’টি স্কুলকে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’ ভাস্করবাবুর দাবি, এ ভাবে এত কম ছাত্রছাত্রী নিয়ে ক্লাস করা সম্ভব নয়। অবস্থার পরিবর্তন না হলে শিক্ষকদের হয় তো অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গিয়ে স্কুলটিই বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে বলে তাঁর আশঙ্কা। সে ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পড়ুয়ারা। পড়উয়ার সংখ্যা বাড়তে প্রচারে নজর দেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন তিনি।

স্কুলের শিক্ষিকা অন্বেষা মণ্ডল, রেশমি জোয়ারদার বলেন, ‘‘ছাত্র না থাকায় প্রায় দিনই কেবল বসে বসে কাটাতে হয়। স্কুলঘর, পানীয় জল, বিদ্যুৎ-সহ জরুরি পরিকাঠামোর উন্নতি না করতে পারলে বেসরকারি স্কুলে ভর্তির প্রবণতা বন্ধ করা সম্ভব নয়।’’ এ বিষয়ে বসিরহাট পূর্ব চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক শৈলেশ পাল বলেন, ‘‘এ কথা ঠিক যে এখানকার কয়েকটি স্কুলের পরিকাঠামোর উন্নতি জরুরি। তবে সাঁইপালা গার্লস ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শেখর পালিত বলেন, ‘‘প্রতিদিন সঠিক সময়ে শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে পৌঁছন। ছাত্রছাত্রীদের নিজের পরিবারের একজন মনে করে শিক্ষাদানের করেন তাঁরা। অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত স্কুলের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। অভিভাবকদেরও এগিয়ে আসতে হবে স্কুলের উন্নতিতে।” সাঁইপালা গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মনোরঞ্জন পালিত। তাঁর জমিতেই স্কুল ঘর। তিনি মারা গিয়েছেন। তাঁরই ছেলে শেখর পালিত। তিনি বলেন, ‘‘শিক্ষা দফতর চাইলে আমরা ওই জমি নিঃস্বার্থ ভাবে স্কুলের জন্য দান করতে প্রস্তুত।’’ এখন দেখার শিক্ষা দফতর কী করে। প্রায় শতাধিক বছরের সাঁইপালা গার্লস স্কুলটি চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়, নাকি তিন কাঠা জমিতে সরকারি অনুদানে গড়ে তোলা হয় নতুন স্কুলবাড়ি।

—নিজস্ব চিত্র।

southbengal nirmal basu kolkata bashirhat reducing the number of public elementary school student
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy