Advertisement
০৩ মে ২০২৪

বিচিত্র সীমানা বিন্যাসে সরকারি কাজে ব্যাঘাত

কাঁটাতারের বেড়াবিহীন এ যেন সীমান্তের কোনও এক গ্রাম যেখানে গৃহস্থের বাসঘর যদি হয় ভারতে তা হলে তাঁর রান্নাঘর বাংলাদেশে। ভৌগোলিক কারণে বাদুড়িয়া পুরসভার বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের অবস্থানও খানিকটা সে রকম। কারও বাড়ি যদি হয় পুরসভার কোনও ওয়ার্ডে, তা হলে সেই বাড়িতে ঢোকার পথ হয় তো পঞ্চায়েত এলাকায়।

রাস্তার এক দিকে পুরসভা। অন্য দিকে, পঞ্চায়েত। এই পরিস্থিতিতে রাস্তা মেরামত করবে কে?

রাস্তার এক দিকে পুরসভা। অন্য দিকে, পঞ্চায়েত। এই পরিস্থিতিতে রাস্তা মেরামত করবে কে?

নির্মল বসু
বাদুড়িয়া শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৫০
Share: Save:

কাঁটাতারের বেড়াবিহীন এ যেন সীমান্তের কোনও এক গ্রাম যেখানে গৃহস্থের বাসঘর যদি হয় ভারতে তা হলে তাঁর রান্নাঘর বাংলাদেশে। ভৌগোলিক কারণে বাদুড়িয়া পুরসভার বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের অবস্থানও খানিকটা সে রকম। কারও বাড়ি যদি হয় পুরসভার কোনও ওয়ার্ডে, তা হলে সেই বাড়িতে ঢোকার পথ হয় তো পঞ্চায়েত এলাকায়। আবার বাড়ি পঞ্চায়েতের সীমানায় হলে কী হবে, রান্না ঘর-গোয়াল ঘর হয় তো পড়েছে পুর এলাকার মধ্যে। কারও বাড়ির একাংশ পুর এলাকার মধ্যে হলেও হয় তো ভোট দেন পঞ্চায়েতে। গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া ওয়ার্ড বিন্যাসের এমনই জটিল অঙ্কের কারণে বাদুড়িয়া পুরসভা কিম্বা গ্রাম পঞ্চায়েতের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হতে হয়, এমনই অভিযোগ মানুষের।

এলাকার বয়স্কদের মুখে শোনা গেল, ব্রিটিশ আমলে ইছামতীর এক পারে তারাগুনিয়া, আড়বালিয়া, রুদ্র পুর এবং অন্য পারে পুঁড়ো-খোড়গাছির জমিদারেরা নাকি নিজেদের সুবিধার কথা ভেবে এবং ভবিষ্যতের তোয়াক্কা না করেই বাদুড়িয়া পুরসভার এমন বিচিত্র ওয়ার্ড বিন্যাস করেছিলেন। বাদুড়িয়ার ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, চার জন জমিদার নদীর দু’পারে তাঁদের নিজের নিজের তালুককে পুরসভার অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। পরেও সেই বিন্যাস আর পরিবর্তিত হয়নি। সে সময়ে পুরভবনের খুব কাছ দিয়ে বয়ে যেত ইছামতী নদী। ইদানীং অবশ্য বেশ কিছুটা দূরে সরে গিয়েছে নদীর গতিপথ। ১৪টি ওয়ার্ড নিয়ে পুরসভা গঠন হলেও পরবর্তিতে তার সংখ্যা বেড়ে হয় ১৭টি। কিন্তু ওয়ার্ড এবং পঞ্চায়েতের এমন জটিল অবস্থানের জন্য উন্নয়নের কাজে খারাপ প্রভাব পড়েছে বলেই মনে করেন স্থানীয় মানুষ। পুরসভার পাকা নর্দমার কাজ হয় তো পঞ্চায়েত এলাকায় গিয়ে থমকে যায়। কোথাও আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের প্রকল্প কিংবা বিদ্যুদয়নের কাজেও এমন জটিলতা দেখা দেয়।

এঁরা থাকেন ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। কিন্তু ভোট দেন জগন্নাথপুর পঞ্চায়েতে।

রাজনৈতিক নেতাদের কথায়, ওয়ার্ড বিন্যাসের কারণেই নাকি সর্বত্র উন্নয়নের চিত্রটা বোঝা যায় না। পুরভবন থেকে আড়বালিয়া পর্যন্ত ৬, ৭ এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে আছে রঘুনাথপুর ও জগন্নাথপুর অঞ্চল। ১, ২ এবং ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে আছে জসাইকাটি-আটঘরা পঞ্চায়েত। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে আছে নয়াবস্তিয়া-মিলনি গ্রাম পঞ্চায়েত। ৯, ১০ এবং ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে জগন্নাথপুর গ্রাম পঞ্চায়েত। নদীর অন্য পারে ১১ থেকে ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে রয়েছে বাজিতপুর গ্রাম পঞ্চায়েত। ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের মাঝ দিয়ে আবার ঢুকে পড়েছে আটুরিয়া পঞ্চায়েত। পুরসভা আর পঞ্চায়েত মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ায় প্রশাসনিক কাজে উন্নয়নের গতি পাচ্ছে না বলে অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। পুরসভার জন্য আসা প্রকল্পের টাকায় যেমন গ্রাম পঞ্চায়েতের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। তেমনি পঞ্চায়েত সমিতি এবং পঞ্চায়েতের জন্য আসা প্রকল্পের কাজ পুর এলাকায় করা যায় না। দুই দফতরের সমন্বয়ের অভাবে নিকাশি থেকে শুরু করে আলো, রাস্তা, পানীয় জলের পাইপ পুর এলাকার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে মাঝপথে পঞ্চায়েত পড়ায় হারিয়ে যায়। পুর এলাকার রাস্তাঘাটের বিদ্যুত্‌ সংযোগ কমে। এ সবের ফলে নদী থাকা সত্ত্বেও নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় বর্ষার দিনে বাদুড়িয়ার বড় অংশের মানুষকে জলে ভাসতে হয়।

বাঁ দিকে, বাড়ি পঞ্চায়েতে। ডান দিকে, গোয়াল পুর এলাকায়।

বসিরহাট থেকে খোলাপোতা হয়ে একটা রাস্তা বাদুড়িয়ার উপর দিয়ে সোজা চলে গিয়েছে মছলন্দপুরের দিকে। ওই রাস্তায় কাজির দোকানের কাছে বাঁ দিক থেকে বেরিয়ে আসা একটা ইটের রাস্তা চলে গিয়েছে গ্রামের মধ্যে। ওই রাস্তার বাঁ দিক বাদুড়িয়া পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড। আর ডান দিকে পড়ে জগন্নাথপুর পঞ্চায়েতের বিষ্ণুপুর গ্রাম। কথা হচ্ছিল ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সামাদ মোল্লার সঙ্গে। তিনি বলেন, “আমরা এক সময়ে পঞ্চায়েত এবং পুরসভায় দু’জায়গাতেই ভোট দিতাম। দু’জায়গার রেশন কার্ডও ছিল।” তবে ইদানীং তেমনটা হয় না বলেই জানালেন। তবে স্থানীয় কিছু মানুষ এখনও দু’জায়গায় ভোট দেন। একটু এগিয়ে ওই পঞ্চায়েতের উত্তর দিয়াড়া গ্রামে গিয়ে কথা হল সামসেল বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি জানালেন, গ্রামের মধ্যে দিয়ে ওয়ার্ডের সীমানা চলে যাওয়ায় পুর কর্তৃপক্ষের তরফে যেমন ইট-সিমেন্টের ড্রেনের কাজ অসমাপ্ত রাখা হয়েছে, তেমনি পঞ্চায়েতের পক্ষে নোংরা পরিস্কারের গাড়ি না থাকায় ড্রেনের মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নর্দমার নোংরা জল বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে। তিলডাঙায় গিয়ে দেখা গেল, মাঝ পথে গ্রাম পড়ায় ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পাকা নর্দমার মুখ বন্ধ। বাদুড়িয়া ঘুরে নিকাশির বহু অব্যবস্থা চোখে পড়ল।

গোলাম রসুল গাজি, আকবর মোল্লা কিংবা আলেয়া বিবিদের মতো বেশ কয়েক ঘর বাসিন্দা থাকেন বাদুড়িয়া পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। কিন্তু তাঁরা ভোট দেন জগন্নাথপুর পঞ্চায়েতে। ওই সব মানুষের কথায়, “পুরসভা এলাকায় বাস করলে কী হবে, ওয়ার্ড আর পঞ্চায়েতের জটিলতায় পঞ্চায়েত থেকেই রেশন তুলি। পঞ্চায়েতে ভোট দিই।” পঞ্চায়েত সদস্য নাকি ওয়ার্ড কমিশনার, কার হাতে প্রকল্পের দায়িত্ব, তা নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় বাদুড়িয়া এলাকার অনেক জায়গাতেই রাস্তা মেরামতি, পানীয় জল কিংবা বিদ্যুতের হাল খারাপ। তারাগুনিয়ার পশ্চিম কারিগর পাড়ার কামাল হোসেনের কথায়, “ইটের রাস্তার ভয়ঙ্কর হাল। রাতবিরেতে সংকীর্ণ, ভাঙাচোরা এই রাস্তা দিয়ে চলতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু রাস্তা মেরামতির নাম নেই। কারণ, ওই রাস্তার এক পাশে পুর এলাকা। অন্য ধার পঞ্চায়েতের।”

জগন্নাথপুর পঞ্চায়েতের আরশুল্যা গ্রামের বাসিন্দা আয়ুব আলি মণ্ডল বলেন, “বাড়ি পঞ্চায়েতে হলেও গোয়াল ঘরটি ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে। দু’জায়গার দু’রকম কর। কেমন যন্ত্রণা বলুন তো।” বাবলু দাসের কথায়, “বাদুড়িয়া পুরনো বাসস্টান্ডের কাছে ৫ নম্বর ওয়ার্ডে আমার বাড়ি। বাড়িতে ঢোকার পথ আবার রঘুনাথপুর অঞ্চল। পুরসভা এলাকায় বাড়ি হওয়ায় আমাকে যে পরিমাণ কর দিতে হয় অঞ্চল এলাকায় বাড়ি হলে তার থেকে অনেকটাই কম দিতে হত।”

তাঁর ক্ষোভ, কার কাছ থেকে শংসাপত্র নিতে হবে, তা নিয়েও বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। তুষার সিংহ, আব্দুর রহিম দিলু বলেন, “বাদুড়িয়া পুরসভার উল্টো দিকে থানার পিছনটা পড়ছে গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। ওয়ার্ডগুলি পাশাপাশি থাকলে উন্নয়নের কাজের সুবিধা হত।” তাঁরা জানালেন, একটা ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে যেতে মাঝে দু’তিন কিলোমিটার রাস্তা পঞ্চায়েতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আবার কোথাও রাস্তার এক ধারে গ্রাম পঞ্চায়েত। অন্য দিকে পুরসভা। দুই দফতরের কাজের ধরন আলাদা আলাদা হওয়া এবং নির্দিষ্ট এলাকায় প্রকল্পের কাজ করতে বাধ্য থাকায় উন্নয়নের কাজ গতি পায় না। আবার করবিন্যাসের ক্ষেত্রেও নানা সমস্যা দেখা দেয়।

এ সব কথা কার্যত অস্বীকার করেননি বাদুড়িয়ার পুরপ্রধান এবং পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। পুরপ্রধান দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “ভৌগোলিক কারণে বাদুড়িয়ার ওয়ার্ড বিন্যাসের ক্ষেত্রে যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তাতে উন্নয়নমূলক কাজের ক্ষেত্রে বড় রকম অসুবিধা দেখা দেয়। কী ভাবে পুরসভা এবং গ্রাম পঞ্চায়েতে আলাদা করে উন্নয়নের কাজে গতি আনা যায়, সেই চেষ্টা অনেকে করলেও বিশেষ সুবিধা হয়নি।” তিনি জানান, পুরসভার বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে। যা দেখে মানুষ ভুল বুঝলেও নিয়ম মেনে প্রশাসন চালাতে গিয়ে আমাদের সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে।

বাদুড়িয়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সোমা আড়দার আবার বলেন, “একই এলাকার মধ্যে দু’টি আলাদা দফতর কাজ করলে সমস্যা তো হবেই। এমন মানুষ আছেন, যাঁদের পুরসভার বিপিএল কার্ড আছে। অথচ পঞ্চায়েতের রেশনকার্ড এবং ভোটার পরিচয়পত্র-সহ বাস করেন। স্বাভাবিক কারণে এমন পরিবারকে সামাজিক, আর্থিক সহায়তা প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সম্ভব নয়। পুরসভা এবং অঞ্চলের বিপিএল কার্ডের ক্যাটাগরি আলাদা। পঞ্চায়েত থেকে বিপিএল কার্ড নিলে অঞ্চলের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে শুরু করে ঘর তৈরি পর্যন্ত করে দেওয়া সম্ভব হত।” তাঁর মতে, এ সব কথা অনেকেই বুঝতে চান না বলে মাঝে মধ্যে প্রশাসনিক কাজে সমস্যা দেখা দেয়।

এই রকম পরিস্থিতিতে পুরসভা, পঞ্চায়েত সমিতি কিংবা পঞ্চায়েতে রাজনৈতিক রং বদল হলেও উন্নয়নের ধারা বার বার থমকে যায়।

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, বাদুড়িয়ার পুরপ্রধান

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shohor nirmal basu baduriya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE