Advertisement
০৩ মে ২০২৪

ম্যাচ খেলার টাকায় পড়া চালায় বিনতারা

কখনও ছোট ছোট পাস, কখনও আবার বল পায়ে লম্বা শট। অজ গাঁয়ের মাঠে প্রতিপক্ষকে গোল-বিধ্বস্ত করার মরিয়া লড়াই চলছে। তা দেখতে উপচানো ভিড়। এমনকী মাঠের পাশের গাছেও অগুনতি মাথা। গাছে বসে মাইক ফুঁকে খেলার ধারা বিবরণীও দিচ্ছেন গ্রামের এক যুবক।

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৪৮
Share: Save:

কখনও ছোট ছোট পাস, কখনও আবার বল পায়ে লম্বা শট। অজ গাঁয়ের মাঠে প্রতিপক্ষকে গোল-বিধ্বস্ত করার মরিয়া লড়াই চলছে। তা দেখতে উপচানো ভিড়। এমনকী মাঠের পাশের গাছেও অগুনতি মাথা। গাছে বসে মাইক ফুঁকে খেলার ধারা বিবরণীও দিচ্ছেন গ্রামের এক যুবক।

‘ধন্যি মেয়ে’ সিনেমার সেই দৃশ্যই বাস্তবে ফিরে ফিরে আসছে হাড়োয়া, সন্দেশখালি, মিনাখাঁর মাঠে। ফারাক মাত্র দু’টো ১) ছেলেরা নয়, মাঠ দাপাচ্ছে মেয়েরা। ২) ফুটবলের বদলে খেলাটা হল ক্রিকেট।

বসিরহাট মহকুমা জুড়েই বিভিন্ন স্থানীয় ক্লাবের উদ্যোগে মেয়েদের ক্রিকেট প্রতিযোগিতা এখন খুব জনপ্রিয়। কোনও পুজো হোক বা মেলা, গ্রামে অনুষ্ঠান হলেই মহিলা ক্রিকেটের আসর বসছে। তা সে গ্রীষ্ম হোক বা বর্ষা কিংবা শীত। বারো থেকে বাইশ বছরের মেয়েরা ব্যাট-বল নিয়ে নেমে পড়েছে মাঠে। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় চলছে খেলা। ‘করব, লড়ব, জিতব’-র ট্যাগলাইনকেই জীবনের মূলমন্ত্র করে ওদের যুদ্ধ জারি। পুরুষের দাপটে কোণঠাসা ময়দানে ব্যাট আর বলকে হাতিয়ার করেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকা। ওই খেলাকেই আরও বড় যুদ্ধের অস্ত্র করে পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছেন ওরা।

বসিরহাট মহকুমার হাড়োয়া, সন্দেশখালি, মিনাখাঁর বেশ কয়েকটি গ্রামও ওদের উত্‌সাহ দিতে সব সময়ে তৈরি। পুজো, মেলা বা অন্য যে কোনও অনুষ্ঠান উপলক্ষেই ক্লাবে ক্লাবে মেয়েদের ক্রিকেট প্রতিযোগিতার আয়োজন করা এলাকার মানুষের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। সে জন্য মাঠ ঘিরে আলো লাগিয়ে আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা করে এলাহি প্রস্তুতি নেন উদ্যোক্তারা। প্রত্যেক ক্লাবের নির্দিষ্ট রঙ-বেরঙের জার্সি পরে শীত, গ্রীষ্ম অথবা বর্ষা যে কোনও পরিস্থিতিতেই খেলোয়াড়রাও স্বচ্ছন্দ।

শুধু মহিলা ক্রিকেট প্রতিযোগিতার আসর বসানো নয়, প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়া নিয়েও গ্রামবাসীদের মধ্যে টান টান উত্তেজনা থাকে। ট্রফির পাশপাশি পুরস্কার হিসেবে ৫ থেকে ২০ হাজার টাকার একটা ভাল অঙ্ক বরাদ্দ থাকে। যার অংশ ক্লাব এবং খেলোয়াড়দের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। তাই গ্রামের ক্লাবে ক্লাবে মহিলা ক্রিকেট দল তৈরি নিয়ে উত্‌সাহ তুঙ্গে থাকে।

মিনাখাঁর নেরুলি ভাই ভাই সঙ্ঘের রাসযাত্রা উপলক্ষে এমনই এক প্রতিযোগিতায় খেলতে এসেছিল আটটি দল। তাদের মধ্যে হাড়োয়ার ট্যাংরামারি জয় মা কালী সবুজ সঙ্ঘের প্রশিক্ষক বিশ্বনাথ দাস বলেন, “একটা সময়ে নেহাতই খেলার জন্য ক্রিকেট খেলা হত। বর্তমানে রীতিমতো প্রশিক্ষক রেখে বছরভর প্রশিক্ষণ দিয়ে তবেই মেয়েদের মাঠে নামানো হয়।” তিনি আরও বলেন, “আর হবে না-ই বা কে। এখন খেলাটাকে গ্রামের মানুষ মর্যাদার লড়াই মনে করে নিয়েছে। মেয়েদের জয়ে যেন গ্রামই জয়ী হয়েছে বলে মনে করা হয়। তাই তো খেলা দেখতে এক গ্রামের মানুষ গিয়ে ভিড় জমান অন্য গ্রামে।”

ওই ক্লাবের পক্ষে আনন্দ সরকার একটু পিছিয়ে গিয়ে বলেন, “বছর পাঁচ আগের কথা, যখন মহিলা ক্রিকেট খেলা শুরু হয়। তখন খেলার জন্য অন্য গ্রাম থেকে ২-৩ হাজার টাকার বিনিময়ে ৫-৬ জন ভাল খেলোয়াড়কে দলে নেওয়া হয়েছিল। তাদের দেখাদেখি পরবর্তী কালে গ্রামের মেয়েরাও খেলা শুরু করে। পুরস্কারের টাকার একটা ভাগ টিফিন, পোশাক, ব্যাট এবং বল কেনার জন্য রেখে বাকিটা খেলোয়াড়দের দেওয়া হয়।”

এই খেলাকে ‘মিনি ক্রিকেট’ বলে জানেন এলাকার মানুষ। মাঠের পরিধি ছোট করে ৩৫ গ্রাম ওজনের প্লাস্টিক বলে সীমিত ওভারের খেলা হয়। মূলত আদিবাসী গরিব ঘরের মহিলারাই এই খেলায় অংশ নেন। ক্রিকেট খেলে ইতিমধ্যে ১০-১২টি ট্রফিও পেয়েছে বলে জানায় বাছড়া এমসি হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী বিনতা বারুই। তার কথায়, “আমরা চার ভাইবোন। বাবার একার আয়ে সংসার চালানো কষ্টকর। ফলে পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে বেশ অসুবিধা হয়। ক্রিকেট খেলে পুরস্কারের যে অর্থ পাই, তা দিয়ে খাতা-কলম কিনি।”

মিনাখাঁর বামুনগাছি হুমায়ুন কবীর মহাবিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী নয়নমণি পাড়ুই বলেন, “এক সময়ে গ্রামে মেয়েদের জন্য বিশেষ কোনও খেলা ছিল না। এখন মিনি ক্রিকেটের দৌলতে আমরা এ গ্রাম ও গ্রাম ঘুরে প্রতিযোগিতায় যোগ দিই। জয়ী হলে গ্রামের মানুষ ব্যান্ড বাজিয়ে আমাদের নিয়ে আনন্দ করেন। খুব মজা হয়!” দশম শ্রেণির পূর্ণিমা দাস বলে ওঠে, “ভাল খেললে ভাল পুরস্কার পাওয়া যায়। আর্থিক সাহায্যও মেলে। তাই এখন গ্রামের গরিব মেয়েরা ক্রিকেট খেলায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে।”

কতগুলি দল খেলে এই মিনি ক্রিকেট? মিনাখাঁর ফুলবাড়ি সবুজ সঙ্ঘ, ফুলবাড়ি শিবশঙ্কর সঙ্ঘ, সন্দেশখালির ঢেকনামারি খ্রিস্টানপাড়া, বয়ারমারি নেতাজী সঙ্ঘ, হাড়োয়ার ট্যাংরামারি সবুজ সঙ্ঘ, মুচিখোলা মিলন সঙ্ঘ, মুনসিঘেরি বান্টি একাদশ, বড়বাড়ি ভাইভাই সঙ্ঘ-সহ প্রায় ১৫-২০টি তো হবেই বলে জানালেন স্থানীয় ক্লাব সদস্য রাহুল ভুঁইয়া, দেবব্রত মান্না, বিপ্লব মণ্ডল। এক ক্লাব কর্তার কথায়, “আমাদের কাছে এখন মিনি ক্রিকেটে জয়ী হওয়া বড় বিষয়। এতে গ্রাম এবং ক্লাবের মান বাড়ে। তাই ক্লাবের পক্ষ থেকেও যথাসাধ্য খরচ করে গড়া হয় শক্তিশালী দল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE