Advertisement
০৫ মে ২০২৪
ইফতার থেকে ইলিশ

উৎসবের আড়াল রেখেই কলেজে দাপট দাদাগিরির

ব্যাখ্যা হতে পারে দু’রকম। বহিরাগতের ক্রমবর্ধমান দাপট কিংবা সরকারের উৎসব-সংস্কৃতির ছোঁয়াচ! রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে প্রহার করে ২০১২ সালে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, পরের তিন বছরে তা একাধিক জেলা ঘুরে আছড়ে পড়েছে খাস কলকাতাতেও। একের পর এক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের হালফিলের দাপট দেখছে মালদহ কলেজ এমনকী খাস কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ মহিলা কলেজ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ০৩:২৮
Share: Save:

ব্যাখ্যা হতে পারে দু’রকম। বহিরাগতের ক্রমবর্ধমান দাপট কিংবা সরকারের উৎসব-সংস্কৃতির ছোঁয়াচ!

রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে প্রহার করে ২০১২ সালে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, পরের তিন বছরে তা একাধিক জেলা ঘুরে আছড়ে পড়েছে খাস কলকাতাতেও। একের পর এক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের হালফিলের দাপট দেখছে মালদহ কলেজ এমনকী খাস কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ মহিলা কলেজ। এর আগে প্রেসিডেন্সি, আলিয়া, মায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও এই ‘দাপট সংস্কৃতির’ হাত থেকে বাদ যায়নি! রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছে ছাত্র সংসদের অফিসে ‘সাহসী’ নাচাগানার আসর! আর প্রায় সর্বত্র বে-লাগাম বিশৃঙ্খলা তৈরিতে অভিযুক্ত শাসক দলের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি এবং তাদের মদতদাতা তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা।

মালদহ কলেজে টিএমসিপি-র জুলুমে দায়িত্ব নেওয়ার আট দিনের মধ্যে মহম্মদ আনুয়ারুজ্জামান অধ্যক্ষ পদে ইস্তফা দিতে চান বলে অভিযোগ। ইফতার আয়োজনের জন্য কলেজ তহবিল থেকে ১০ হাজার টাকা চেয়ে টিএমসিপি-র ছাত্র সংসদ তাঁকে চাপ দিয়েছিল বলে অভিযোগ। এর পরেই ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পরিচালন সমিতির সভাপতি কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীর কাছে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেন আনুয়ারুজ্জামান। যদিও শনিবার সন্ধ্যায় পরিচালন সমিতির বৈঠকের পরে অধ্যক্ষ জানান, শিক্ষামন্ত্রী তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। কৃষ্ণেন্দুবাবুও পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। তাই ইস্তফার সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত ফিরিয়ে নিলেন অধ্যক্ষ।

শিয়ালদহের সুরেন্দ্রনাথ মহিলা কলেজে আবার ছবিটা অন্য রকম। সেখানে শিক্ষক ঠেঙানোর মতো ঘটনা ঘটেনি এখনও! সেখানে এখন উৎসবের মরসুম! যার মূল আয়োজক, শিয়ালদহ এলাকায় তৃণমূলের নেতা দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘গালকাটা দেবু’ নামেই যিনি এলাকায় বেশি পরিচিত এবং যাঁর সঙ্গে ওই মহিলা কলেজের এমনিতে কোনও সংশ্রব নেই। তাঁর উদ্যোগেই শনিবার সন্ধ্যায় সুরেন্দ্রনাথ সান্ধ্য কলেজে ইফতার আর আগামী কাল, অর্থাৎ সোমবার সুরেন্দ্রনাথ মহিলা কলেজে ইলিশ উৎসব! রাজনৈতিক নেতারা যে ইদানীং ইফতার বা বিজয়া সম্মেলনকে জনসংযোগের হাতিয়ার করছেন, তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় নেই। কিন্তু হঠাৎ করে কলকাতার বুকে একটি মহিলা কলেজে এমন আয়োজনে ছাত্র-অভিভাবক-শিক্ষক-শিক্ষানুরাগীদের অনেকেই বিস্মিত। তা-ও আবার এমন দিনে, এমন সময়ে, যখন সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা চলবে! প্রসঙ্গত, আগামী কাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট-টু ( জেনারেল) পরীক্ষা রয়েছে।

রবীন্দ্রভারতী থেকে মালদা কলেজ হয়ে কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ— দাপটের এই ছবিটা কি শুধুই উৎসব-সংস্কৃতির? মানতে নারাজ ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের বড় অংশই। তাঁদের বক্তব্য, প্রশ্নটা ইলিশ-উৎসব বা ইফতারের নয়। প্রশ্নটা ক্ষমতা প্রদর্শনের। এই সব আয়োজনের আড়ালে প্রমাণ করা যে, ‘এই কলেজে আমিই সর্বেসর্বা! আমার কারও কোনও অনুমতির দরকারই নেই!’ সর্বত্রই তার প্রমাণও মিলছে!

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার চলাকালীন এমন একটা কাণ্ড সম্ভব হচ্ছে কী করে? ওয়াকিবহাল লোকেরা বলছেন, ‘‘কারণ একটাই। গালকাটা দেবুর দাপট!’’ কলেজ সূত্রেই খবর, বছর ৫০-এর দেবুবাবুকে ভয় পান সকলেই। কেন তাঁকে গালকাটা দেবু বলে লোকে? পুলিশের এক সূত্রের বক্তব্য, ‘‘নেপথ্যের কাহিনিটা এ রকম। এক সময় এলাকার দাপুটে দাদা নান্টুর সঙ্গে মারামারিতে কান থেকে গাল অবধি লম্বা করে কেটে যায় দেবুর। ক্ষত সেরে গেলেও দাগ থেকে যায়। সেই থেকেই লোকমুখে ওই নাম। আর তার পর থেকে দেবুর দাপটও বেড়েছে!’’ তিনি এখন সুরেন্দ্রনাথে ছাত্র ভর্তি থেকে শুরু করে সব ব্যাপারেই শেষ কথা বলেন বলে কলেজ সূত্রেরই খবর। দেবুবাবু অবশ্য

সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সঙ্গে তাঁর বাড়তি সংযোজন, ‘‘আইনের ডিগ্রি রয়েছে আমার!’’

শনিবার সুরেন্দ্রনাথ সান্ধ্য কলেজে গিয়ে নজরে পড়ল চার দিকে আলোর সাজ। দেওয়ালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় ছবি। ছাত্রদের বক্তব্য, তাঁরা ইফতারের আয়োজন করেছেন। পরে সদলবল যোগ দেন টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্র ও সাধারণ সম্পাদক তমোঘ্ন ঘোষ। কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র মাইতিও যোগ দেন ইফতারে। কলেজের ভিতরে ইফতার কেন? অধ্যক্ষের জবাব, ‘‘এটা নতুন নয়। প্রায় কুড়ি বছর ধরে দেখছি।’’

সুরেন্দ্রনাথ সান্ধ্য কলেজের সঙ্গে কোনও যোগ নেই দেবুবাবুর। তিনি সুরেন্দ্রনাথ আইন কলেজের পরিচালন সমিতির সদস্য। কিন্তু সেটাকে কাজে লাগিয়েই তিনি সুরেন্দ্রনাথ গ্রুপের সব কলেজে জোর খাটান বলে অভিযোগ। শনিবার দুপুরে সুরেন্দ্রনাথ মহিলা কলেজে নিজে দাঁড়িয়ে সোমবারের উৎসবের তদারক করেছেন।

কেন এই আয়োজন? দেবুবাবু এ দিন জানান, দীপক মল্লিক নামে এক শিক্ষাকর্মী অবসর নিচ্ছেন। তাই একটু খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু দেবুবাবু যা জানাননি, তা হল, গত মে মাসে অবসরের পরে দীপকবাবু ইতিমধ্যেই দু’বছরের জন্য পুনর্নিযুক্ত হয়েছেন! তাই তাঁর অবসরকে কেন্দ্র করে খাওয়া-দাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না বলে দেবুবাবুর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর বক্তব্য।

একটি মহিলা কলেজে এ ভাবে বহিরাগত এক জন বা তাঁর সঙ্গীরা ঢোকে কী করে? অধ্যক্ষা পূর্ণিমা বিশ্বাস মুখোপাধ্যায়ের জবাব, ‘‘মাত্র কয়েক দিন আগে এই দায়িত্বে এসেছি। কিছু ছাত্রী এসে আমাকে ইলিশ আর খিচুড়ি খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে। শুনলাম, এই কলেজে না কি এ রকম হয়। তাই বাধা দিইনি।’’ কিন্তু ওই দিন যে পরীক্ষা রয়েছে! অধ্যক্ষার বক্তব্য, ‘‘পরীক্ষা থাকলেও ওই দিন পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কম। তাই আপত্তি করিনি।’’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘‘এই ব্যাপারে কিছু জানি না। খোঁজ নেব। তবে পরীক্ষার্থীদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সেটা কলেজ কর্তৃপক্ষের নিশ্চিত করা দরকার।’’

তৃণমূলের স্থানীয় স্তরের এক নেতার এত দাপট কীসের জোরে? স্থানীয় সূত্রে খবর, দেবুবাবুর মাথায় ‘আশীর্বাদ’ রয়েছে তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি যে দেবুকে ভালই চেনেন, তা জানিয়ে সুদীপবাবু বলেন, ‘‘ওরা যদি কোনও শিক্ষাকর্মীর অবসর ঘিরে এই আয়োজন করে থাকে, তাতে দোষ কী?’’ পাশাপাশি বলেন ‘‘দেবুকে যে ভাবে চিত্রিত করা হয়, সেটা ঠিক নয়!’’

দাপট-রহস্যের এটাও একটা কারণ বটে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE