এসি থ্রি-টিয়ারে উঠেই চক্রবর্তী পরিবার দেখল, তাদের বার্থ জবরদখল!
বার্থের ওপরে, গায়ে, খাঁজে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে দখলকারীরা। এগোবেন কি পিছোবেন ভাবতে ভাবতেই কপালে পাতলা পাখার ফরফ়রে ঝাপট খেলেন শম্পা চক্রবর্তী। তত ক্ষণে কামরার অন্য যাত্রীরাও হইচই শুরু করে দিয়েছেন। গুয়াহাটি-শিয়ালদহ কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের গোটা বি-থ্রি কামরাটাই চলে গিয়েছে আরশোলা-বাহিনীর দখলে!
রবীন্দ্রনাথ নস্কর, অসীম চক্রবর্তী, তরুণকান্তি মণ্ডলরা এখনও ভুলতে পারছেন না রবিবার রাতে গুয়াহাটিতে ট্রেনে ওঠার পর থেকে সোমবার রাত পর্যন্ত প্রায় ২৪ ঘণ্টার সেই গা ঘিনঘিনে সফর। কামরার মেঝেয় পা রাখাই যাচ্ছে না প্রায়। মাঝের বার্থ খুলতেই ছিটকে পড়ছে কুচো আরশোলা। কাগজের প্যাকেট-বন্দি ‘বেডরোলে’ও আরশোলা। বেসিনের নীচে ডাস্টবিনটার অবস্থা কহতব্য নয়।
রাত বাড়তে আরশোলার ফরফরানির সঙ্গে যোগ হল ইঁদুরের খুটখুট। শুধু বার্থে-মেঝেতে দৌড় নয়, যাত্রীদের হাতে-পায়ে দাঁত বসানোও শুরু করল তারা। কামরাটা তখন চলন্ত নরক। বাচ্চারা কাঁদছে, মহিলারা চিৎকার করছেন। ট্রেনে টিটিই-কে লাগাতার অভিযোগ জানিয়ে যাচ্ছিলেন যাত্রীরা। তিনি চটজলদি কোনও সুরাহা করতে পারেননি। শেষমেশ নিউ বঙ্গাইগাঁওয়ে চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে শুরু হল বিক্ষোভ। কিন্তু সেখানকার স্টেশন মাস্টারবাবুও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার লিখিত আশ্বাসটুকু ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেননি।
অগত্যা ‘নরকে’ ফেরা। বাচ্চাদের কানে তুলো গুঁজে তাদের ঘুম পাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে বাকি রাতটুকু জেগে পার করা। পরের দিন সকালে ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছতে আবার নেমে অভিযোগ লেখাতে যাওয়া। ‘দার্জিলিঙের দরজা’ এনজেপি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন। হয়তো তাই ফলও মিলল। রেলকর্মীরা কীটনাশক ছিটিয়ে গেলেন কামরায়। দূর হটল ইঁদুর-আরশোলা যৌথ বাহিনী। ট্রেন চলল।
আর কীটনাশকের গন্ধটুকু মিলিয়ে যেতে যেতেই ‘বাহিনী’ জানান দিল, তারা দিব্যি আছে। কিছু ক্ষণের জন্য স্রেফ গা ঢাকা দিয়েছিল, এই যা! আবার শুরু হল কিলবিলে দৌড়, ফরফরে উড়ান, কুটকুটে কামড়।
রাতে ট্রেন শিয়ালদহে পৌঁছনো পর্যন্ত চলল অত্যাচার।
গাঙ্গুলিবাগানের ব্যবসায়ী অসীমবাবু বিধ্বস্ত অবস্থায় মঙ্গলবার বলছিলেন, ‘‘টিকিটের টাকাটাই তো জলে গেল। সব থেকে খারাপ লাগছে, রেল কর্তৃপক্ষের তরফে ‘সরি’টুকুও কেউ এখনও কেউ বলেননি।’’ ট্রেনে ইঁদুর-আরশোলার উপদ্রব নতুন নয়। তাদের জ্বালায় এর আগেও উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলে কখনও পদাতিক, কখনও দার্জিলিং মেল, কখনও বা জনশতাব্দীতে অতিষ্ঠ হতে হয়েছে রেলযাত্রীদের। অথচ রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর দৌলতে যথেষ্ট ‘হাইটেক’ হয়েছে রেল। প্রধানমন্ত্রীর ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযান চালুর পর স্টেশন ও ট্রেনের কামরায় পরিচ্ছন্নতায় জোর দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
কিন্তু ফল কী হয়েছে? ছুটিতে সপরিবার অরুণাচলে বেড়িয়ে ওই কামরায় ফিরছিলেন রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তরুণকান্তি মণ্ডল। বললেন, ‘‘আমার মেয়ে তিয়াষার পায়ে ইঁদুরে কামড়েছে। কলকাতায় ফিরে ডাক্তার দেখালাম।’’
ঘটনা শুনে রেলকর্তারা বলছেন, প্রতিটি কামরাই একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে কারশেডে নিয়ে গিয়ে ‘পেস্ট কন্ট্রোল’ করা হয়। এমনকী এখন কামরার মধ্যেই লেখা থাকে, শেষ কবে পোকামাকড়ের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। তা-ও কেন এমন হল, ব্যাখ্যা নেই কারও কাছে। ওই ট্রেনের যাত্রীদের অভিযোগ খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন কর্তারা। তবে রেলে যে সব কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, তার কার্যকারিতা যে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, কর্তাদের একাংশই তা স্বীকার করে নিয়েছেন।
অঙ্কন: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy