মায়ের সঙ্গে অঙ্কুশ। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ।
হাসি লেগেই রয়েছে অঙ্কুশের মুখে। কিন্তু যতই সে হাসে, বাবা-মায়ের কপালে চিন্তার খাঁজগুলো যেন আরও গভীর হয়।
রানিগঞ্জের জয়ন্ত শীট ও পিউ শীটের চিন্তার কারণও রয়েছে। তাঁদের ছেলে অঙ্কুশের ১৫ মাস বয়স হয়ে গেল। পাড়ায় তার বয়সী ছেলেমেয়েরা হাঁটতে শিখছে। কিন্তু অঙ্কুশ এখনও হামাগুড়িও দিতে পারে না। একটু গিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এক হাতে টাল সামলাতে পারে না সে।
মাত্র মাস তিনেক বয়সেই একটা হাত হারাতে হয়েছে ছোট্ট অঙ্কুশকে। পরিবারের ক্ষোভ, এক বছর আগে, ২০১৬-র ১ ফেব্রুয়ারি অঙ্কুশের হাত বাদ যাওয়ার পিছনের কারণ— সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গাফিলতি।
নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর রক্তপরীক্ষার জন্য কনুইয়ের উপরে ‘টুর্নিকেট’ (রবারের ব্যান্ড) বেঁধেছিলেন আসানসোল হাসপাতালের নার্স। খুলতে ভুলে যান। সোয়েটারের তলায় চাপা পড়ে ৭২ ঘণ্টা তা রয়ে যায় হাতেই। বন্ধ হয়ে যায় রক্ত চলাচল। অঙ্কুশ টানা কেঁদে যাচ্ছিল। অভিযোগ, ডাক্তার-নার্সেরা আমলই দেননি। পরে কেন কাঁদছে তা ধরা পড়তেই তড়িঘড়ি তাকে পাঠানো হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। অস্ত্রোপচার করে বাদই দিতে হয় নীল হয়ে যাওয়া ডান হাত।
উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত শুরু হয়েছিল। কিন্তু বছর পেরোলেও তার রিপোর্ট বেরোয়নি। ছেলের হাত বাদ যাওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হয়েছিলেন শীট দম্পতি। নবান্ন থেকে ডেকে তাঁদের এক লক্ষ টাকার ফিক্সড ডিপোজিটের সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। সরকারি সাহায্য বলতে সেটুকুই।
পিউ বলেন, ‘‘আর পাঁচটা বাচ্চার মতো স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠতে পারত আমার ছেলে। কিন্তু ডাক্তার-নার্সদের গাফিলতিতে এখন ওকে জীবনে অনেক ঠোক্কর খেতে হবে। আজ ও হাতের মর্ম বোঝে না। খালি হাসে। কিন্তু আমরা তো বুঝি...।’’ মিনিবাসে খালাসির কাজ করতেন জয়ন্তবাবু। কিছু দিন আগে বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরি গিয়েছে। দিনমজুরি করে, চেয়েচিন্তে সংসার চালাচ্ছেন। তার মধ্যে ছেলের জন্য মাসে ওষুধপথ্যের দাম বাবদ হাজার চারেক টাকা জোগানো দুষ্কর।
জয়ন্তবাবুর দাবি, ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে সরকারি তদন্ত কমিটির কাছে আবেদন করেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। তাই তাঁরা ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছেন। তবে মামলা করার আগে শেষ বার তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে আবেদন করেছেন। তার পরেও মাসখানেক কেটে গিয়েছে।
তদন্ত এখন কোন পর্যায়ে? স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গাফিলতিতে অভিযুক্ত চিকিৎসক ও দু’জন নার্স এখনও সাসপেন্ড রয়েছেন। তদন্ত কমিটি শেষ বার আসানসোলে এসেছিল গত ২৭ সেপ্টেম্বর। স্বাস্থ্য দফতরের সহ-অধিকর্তা মনিকা গায়েন শুধু বলেন, ‘‘তদন্ত এখনও শেষ হয়নি।’’ তবে আসানসোল পুরসভার মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারির দাবি, পুরসভার তরফে পরিবারটিকে গীতাঞ্জলি প্রকল্পে বাড়ি তৈরির টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে তা দেওয়া হবে।
আসানসোলের চিকিৎসক অরুণাভ সেনগুপ্তর আশ্বাস, ‘‘বাচ্চাটা এক হাতে হামাগুড়ি হয়তো দিতে পারবে না। কিন্তু দাঁড়ানো বা হাঁটাচলায় সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বড় হওয়ার সঙ্গে এক হাতে কাজ করাও অভ্যাস হয়ে যাবে।’’ বাবা-মায়ের মন কি তাতে মানে? দু’জনেই বলছেন, ‘‘এখন না হয় আমরা খেয়াল রাখছি। কিন্তু বড় হয়ে ও কতটা কী করতে পারবে, বড্ড ভাবনা হচ্ছে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy