তিনি শাহবানুর নাম শোনেননি।
তাৎক্ষণিক তিন তালাক রদে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের কথাও জানেন না।
উলুবেড়িয়ার যদুরবেড়িয়ার মাবিয়া বেগম নিরক্ষর। দু’বছর আগে সাংসারিক অশান্তির জেরে স্বামীর ঘর ছাড়তে হয়। তখনই পণ করেন, অধিকারের ‘লড়াই’ ছাড়বেন না। স্বামীর ‘তালাকনামা’কে উড়িয়ে দিয়ে সেই ‘লড়াই’ আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছেন ৬০ বছরের ওই বৃদ্ধা। তাঁর জেদ, ‘‘তালাকনামা-র জুজু দেখিয়ে আমাকে দমানো যাবে না।’’
খড়্গপুরের মাদপুরের চাল ব্যবসায়ী আকবর আলি খানের সঙ্গে মাবিয়ার বিয়ে হয় চল্লিশ বছর আগে। তাঁদের তিন ছেলে, পাঁচ মেয়ে। দাম্পত্যের মাঝপথে আকবর ফের বিয়ে করেন। মাবিয়ার অভিযোগ, দ্বিতীয় বিয়ে করার পর থেকে তাঁর উপরে স্বামীর অত্যাচার শুরু হয়। সইতে না-পেরে ১৬ ও ১৪ বছরের দুই ছেলেকে নিয়ে ২০১৫-তে কিছু দিনের জন্য বাপের বাড়ি চলে আসেন। গ্রাম্য সালিশির পরে শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেলেও আকবর ফের মেরে-ধরে তাঁকে তাড়িয়ে দেন বলে অভিযোগ।
২০১৬ সালের গোড়াতেই পাকাপাকি ভাবে দুই ছেলেকে নিয়ে উলুবেড়িয়ায় ফেরেন মাবিয়া। আর্থিক সঙ্কটে শুরু করেন পরিচারিকার কাজ। ওই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি মাসিক ১৫ হাজার টাকা করে খোরপোশ চেয়ে তিনি স্বামীকে আইনজীবীর চিঠি পাঠান। কিন্তু আকবর পাল্টা আইনজীবীর চিঠি দিয়ে স্ত্রীকে জানান, তিনি তালাক দিয়েছেন। সঙ্গে পাঠান তালাকনামা।
দমে না-গিয়ে ওই বছরেরই এপ্রিলে উলুবেড়িয়া আদালতে স্বামীর বিরুদ্ধে খোরপোশের মামলা করেন মাবিয়া। তখনও তাৎক্ষণিক তিন তালাক রদে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়নি। ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর উলুবেড়িয়া আদালতের বিচারক রায় দেন, আকবর যেন মাবিয়া এবং তাঁর দুই ছেলেকে খোরপোশ বাবদ মাসে ৮ হাজার টাকা করে দেন। রায়ের পরেও আকবর একটি পয়সাও মাবিয়াকে দেননি বলে অভিযোগ। এ বার স্বামীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করেন মাবিয়া। ২ অগস্ট সেই মামলার শুনানিতে বিচারককে মাবিয়া বলেন, ‘‘স্বামী তাড়িয়ে দেওয়ায় খোরপোশ চাইলাম। বদলে বুড়ো বয়সে আমায় তালাকনামা পাঠাল। এক জন মহিলার কাছে এর থেকে অবমাননার আর কী হতে পারে!’’ বিচারক পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন ২৭ সেপ্টেম্বর।
খোরপোশের মামলা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি বছর পঁয়ষট্টির আকবর। তাঁর দাবি, ‘‘মাবিয়াকে ওঁর সব প্রাপ্য দিয়েছি।’’ মাবিয়ার পাল্টা দাবি, ‘‘এক পয়সাও দেয়নি।’’ মাবিয়াকে আইনি সহায়তা দিচ্ছেন উলুবেড়িয়ার যুবক শেখ আজিজুর। তিনি বলেন, ‘‘এই ঘটনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে তালাক নিয়ে কড়া আইন কতটা জরুরি।’’
আশির দশকে উত্তরপ্রদেশে জনৈক মুসলিম আইনজীবী ৪০ বছর একসঙ্গে ঘর করার পর তাঁর ৭০ বছরের বৃদ্ধা স্ত্রী শাহবানুকে তালাক দেন৷ শাহবানু আদালতে খোরপোশের আবেদন জানান। আদালত তা মঞ্জুর করে৷ এরপর তাঁর স্বামী সুপ্রিম কোর্টে গেলে শীর্ষ আদালত তা বহাল রাখে। কিন্তু তৎকালীন সরকার পরে সংসদে নয়া আইন প্রণয়ন করায় তা কার্যত রদ হয়ে যায়।
দেশে তোলপাড় ফেলা সেই ঘটনা মাবিয়া জানেন না। তিনি শুধু জানেন, ‘‘ছেলে দু’টোকে নিয়ে তো বাঁচতে হবে!’’