মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে অঙ্গ দান করে নজির তৈরি করেছিলেন ৭১ বছরের শোভনা সরকার। ওই রাতেই দুই রোগীর দেহে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল তাঁর কিডনি। গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহের ওই ঘটনা মরণোত্তর অঙ্গদানের আন্দোলনকে এক ধাক্কায় অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু দু’মাসের মধ্যেই দেখা গেল একটি কিডনি প্রতিস্থাপন ইতিমধ্যেই ব্যর্থ হয়েছে। অন্যটির সাফল্য ঘিরে তৈরি হয়েছে ঘোরতর সংশয়।
আর এই ঘটনা কয়েকটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথমত, এ রাজ্যে অঙ্গ প্রতিস্থাপন যাঁরা করছেন, সেই চিকিৎসকেরা অঙ্গদানের নিয়ম(দাতার অঙ্গ গ্রহীতা নিতে পারবে কি না সেই পরীক্ষা) অনুসরণ করেছেন কি? দ্বিতীয়ত, এই অস্ত্রোপচারে যে সতর্কতা দরকার (সংক্রমণ ঠেকানো ইত্যাদি) তা নেওয়া হচ্ছে কি? তৃতীয়ত, এই ধরনের প্রতিস্থাপনের যে পরিকাঠামো (আলাদা অপারেশন থিয়েটার) থাকা দরকার, তা কলকাতায় আছে কি?
যে চিকিৎসকেরা দু’টি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন তাঁদের দাবি, দাতার কিডনি গ্রহীতার শরীরে খাপ খাবে কি না সেই পরীক্ষা করেই প্রতিস্থাপন হয়েছিল। সরকারি তরফেও এক সঙ্গে দু’টি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেই এমন সমস্যাকে ‘কাকতালীয়’ বলে দাবি করা হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, পরিকাঠামোর কোনও সমস্যা নেই। সব দিক থেকে রাজ্য তৈরি।
কিন্তু অঙ্গদান আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের অনেকেরই আশঙ্কা, শোভনা সরকারের অঙ্গদানের ক্ষেত্রে যা ঘটল তাতে কিছুটা ভাটা পড়তে পারে মানুষের উৎসাহে। একেই রাতবিরেতে কারও মৃত্যু হলে সেই দেহ হাসপাতালে জমা দিতে যে কাঠখড় পোড়াতে হয়, তাতে দাতাদের পরিবার তিতিবিরক্ত। তার উপরে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে উৎসাহীরা আরও পিছিয়ে যেতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।
শোভনাদেবীর একটি কিডনি বসেছিল রামগড়ের কেয়া রায়ের শরীরে। অস্ত্রোপচার হয়েছিল বেলভিউ ক্লিনিকে। আপাতত কেয়া ভর্তি বাইপাসের আর একটি বেসরকারি হাসপাতালে, চিকিৎসক দিলীপ পাহাড়ির তত্ত্বাবধানে। দিলীপবাবু জানান, কেয়ার প্রতিস্থাপিত কিডনিটি বার করে নিতে হয়েছে। আপাতত ডায়ালিসিস চলছে তাঁর। ফের যদি প্রতিস্থাপন করতে হয়, তা হলে কয়েক লক্ষ টাকা খরচের পাশাপাশি কেয়ার শারীরিক প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে অন্তত আট মাস। জোগাড় করতে হবে অন্য একজন দাতা।
অপর গ্রহীতা, এসএসকেএমে ভর্তি শেখ ফিরোজের দেহে কিডনি প্রতিস্থাপনের পরে ছত্রাক সংক্রমণ হয়েছে। তাঁর প্রতিস্থাপন করেছিলেন নেফ্রোলজিস্ট রাজেন্দ্রনাথ পান্ডে। অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতালেই রয়েছেন ফিরোজ। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, তাঁর প্রতিস্থাপন ঘিরেও সমস্যা তৈরি হয়েছে।
কেয়াদেবীর প্রতিস্থাপন যিনি করেছিলেন, সেই নেফ্রোলজিস্ট প্রতিম সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘প্রতিস্থাপনের সাফল্য নিয়ে আগে কিছু নিশ্চিত করা যায় না। তা ছাড়া শোভনাদেবীর বয়স ৭১, চিকিৎসা পরিভাষায় ‘মার্জিনাল ডোনার’। প্রতিস্থাপন সফল হলেও সেই কিডনি তিন-চার বছরের বেশি কাজ করত না।’’ সেটা জেনেও প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল কেন? তিনি বলেন, ‘‘যে হেতু অঙ্গের জোগান খুবই কম, তাই অন্য কোনও বিকল্পও তো রোগীদের সামনে থাকছে না। যত বেশি মানুষ এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবেন, তত বিকল্পের সুযোগ থাকবে। শুধু কলকাতা নয়, জেলাতেও অর্গান রিট্রিভাল সেন্টার তৈরি করতে হবে। আমরা সরকারকে সে কথা একাধিক বার লিখেছি।’’
রাজ্যের অনেক নেফ্রোলজিস্টই বলছেন, প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে যাঁর শরীর থেকে অঙ্গ নেওয়া হচ্ছে তাঁর বয়স এবং শারীরিক সক্ষমতা দুটিই বিচার্য। এক প্রবীণ নেফ্রোলজিস্টের কথায়, ‘‘এ ক্ষেত্রে শুধু দাতার বয়স বেশি ছিল তা-ই নয়, তাঁর ক্রিয়েটিনিনও বেশি ছিল। তাড়াহুড়োর মধ্যে এই ধরনের প্রতিস্থাপনগুলি করতে হয় তা ঠিক, কিন্তু তার আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলি না করালে গোটাটাই ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’’
আর এক প্রবীণ নেফ্রোলজিস্ট বলেন, ‘‘দীর্ঘ রোগভোগে যাঁরা মারা যান, তাঁদের তুলনায় দুর্ঘটনায় মৃতদের দেহ থেকে অঙ্গ নেওয়া হলে তা বরং বেশি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সে ব্যাপারে সরকারি তরফে কোনও চেষ্টাই নেই। তাই মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে অঙ্গদান ও তা প্রতিস্থাপনে কিছু মানুষকে নতুন জীবন দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়েই থাকছি।’’
শোভনাদেবীর ছেলে প্রসেনজিৎ সরকার বলেন, ‘‘গোটা বিষয়টি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। চিকিৎসাবিজ্ঞানের খুঁটিনাটি বিষয় তো আমরা বুঝব না। সে সম্পর্কে ডাক্তারবাবুদের ওপরেই ভরসা করব। দু’টি ক্ষেত্রে ফলাফল এক বলেই আমি একে কাকতালীয় বলে মানতে পারছি না।’’ মরণোত্তর অঙ্গদান নিয়ে কাজ করে এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে ভাস্কর সিংহর অবশ্য অভিযোগ, ‘‘এখনও পর্যন্ত অঙ্গ নেওয়ার জন্য কোনও পরিকাঠামোই গড়ে ওঠেনি এ রাজ্যে। মানুষ জানেনই না কার কাছে যাবেন।’’
অঙ্গদানের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা অদিতি কিশোর সরকারের দাবি, ‘‘সরকার সব রকম ভাবে প্রস্তুত। সরাসরি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে কাউকে ফেরানোর প্রশ্নই ওঠে না।’’ কিন্তু যাঁরা তাকে চেনেন না, তাঁরা কোথায় যাবেন? সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলি তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পত্রপাঠ বিদায় করে দিচ্ছে আগ্রহীদের। তিনি বলেন, ‘‘প্রথম দিকে হয়তো একটু ভুল হচ্ছে। ধীরে ধীরে সবটাই ঠিক হবে। সমস্ত মেডিক্যাল কলেজকেই আমরা এ ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy