Advertisement
E-Paper

মাঝ রাতে কাঁপুনিতে ভাঙল ঘুম

চোখের সামনে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে পাথর। ছোটাছুটি করছেন লোকজন। শনিবার দুপুরে গাড়ি থেকে সেই দৃশ্য দেখে প্রথমে বুঝতেই পারিনি ভূমিকম্প হচ্ছে। কালিগণ্ডকী নদীর সেতুর কাছে পৌঁছে রাস্তায় অজস্র লোক দেখে গাড়ি থামান চালক রমেশ আচার্য। জানতে পারলাম, গত দু’মিনিটে একাধিক বার কেঁপেছে নেপালের মাটি। ভেঙে পড়েছে বহু বাড়ি।

কুন্তলকুমার দে

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৮

চোখের সামনে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে পাথর। ছোটাছুটি করছেন লোকজন। শনিবার দুপুরে গাড়ি থেকে সেই দৃশ্য দেখে প্রথমে বুঝতেই পারিনি ভূমিকম্প হচ্ছে। কালিগণ্ডকী নদীর সেতুর কাছে পৌঁছে রাস্তায় অজস্র লোক দেখে গাড়ি থামান চালক রমেশ আচার্য। জানতে পারলাম, গত দু’মিনিটে একাধিক বার কেঁপেছে নেপালের মাটি। ভেঙে পড়েছে বহু বাড়ি। রাস্তা জুড়ে ফাটল। গাড়ি থেকে নেমে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলছি, হঠাৎ পায়ের তলায় মাটি কেঁপে উঠল। গাড়ির চালক চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘তাড়াতাড়ি ফাঁকা জায়গায় যেতে হবে আমাদের। না হলে টিলা থেকে গড়িয়ে এসে বিপদ হয়ে যাবে।’’ গাড়িতে উঠে রওনা দিলাম সকলে।

ঝাড়গ্রাম ও কলকাতার ১৯ জন পর্যটককে নিয়ে এ বার নেপালে এসেছি। সংস্থার কর্মীদের ধরলে পুরো দলটা ২৩ জনের। ১৯ এপ্রিল থেকে ঘুরছি আমরা। শনিবার সকালে জলখাবার খেয়ে পোখরা থেকে পালপা জেলার তানসেন রওনা দিয়েছিলাম দু’টি বড় গাড়িতে। মাঝরাস্তায় বাধ সাধল ভূমিকম্প। আমার কাছে নেপালের একটা মোবাইল ছিল। সেটা থেকেই কয়েক জন বাড়িতে ফোন করে দিলেন। ঝাড়গ্রাম থেকে আমার স্ত্রীও ভয় পেয়ে ফোন করল। বললাম, ‘‘চিন্তা করো না। আমরা ঠিক আছি।’’ মুখে সে কথা বললাম বটে, কিন্তু চিন্তা বাড়ছিল। দলে যে তিন বছরের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধও রয়েছেন!

দুপুর দেড়টা নাগাদ তানসেনে পৌঁছে দেখি স্থানীয় নগরপালিকা কার্যালয়ের সামনে ফাঁকা জায়গায় প্রচুর লোকজন জড়ো হয়ে রয়েছেন। ‘হোটেল ক্রাউন’-এ বুকিং ছিল। হোটেল মালিক আশ্বস্ত করলেন, হোটেল সদ্য তৈরি হয়েছে, ভেঙে পড়ার ভয় নেই। তবে ভূমিকম্পের পর থেকেই লোডশেডিং চলছে। বাইরের কিছু লোক আশ্রয় নিয়েছে ওই হোটেলে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে আর কোথাও বেরনোর ঝুঁকি নিলাম না। কিন্তু রাতে খাওয়ার আয়োজন তো করতে হবে! অগত্যা সন্ধেয় স্থানীয় বাজারে গেলাম মুরগির মাংস কিনতে। সাতটা নাগাদ ফের মাটি কেঁপে উঠল। ছুটতে ছুটতে ফিরলাম হোটেলে। সেখানে সবাই ছোটাছুটি করছেন। কিছুক্ষণ পরে অবশ্য আলো এল। টিভি চালিয়ে দেখলাম ধ্বংসের ছবি। আর তারপরই আতঙ্কের পারদ চড়ল। সকলের তখন একটাই চিন্তা, রাতে ফের ভূমিকম্প হলে কী হবে! সবাইকে ভোটার কার্ড, টাকা ও মোবাইল সঙ্গে নিয়ে শুতে বললাম। যাতে বিপদ হলে ওগুলো নিয়ে হোটেলের বাইরে বেরোতে পারেন।

ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, কাঠমান্ডুতে যে ধরহরা টাওয়ার দেখে এলাম, সেটা নেই। স্যায়েঙজা জেলার চানচাণ্ডি মন্দিরটা নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভক্তপুরের পুরনো মন্দিরটাও ধুলোয় মিশে গিয়েছে। গত কয়েক দিনে নেপালের যে মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, তাঁরা কেমন আছেন কে জানে!

রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ ঘুম ভেঙে গেল। খাট কাঁপছে। বাইরে কোলাহল। হোটেলের সবাই বাইরে ছুটছে। তড়িঘড়ি বেরিয়ে আমাদের দলের সকলের খোঁজ নিয়ে নিলাম। ঝাড়গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী অশীতিপর নির্মল কুণ্ডু ও তাঁর স্ত্রী প্রতিমাদেবী হোটেলের ঘরে লেপ ঢাকা নিয়ে কাঁপছিলেন। বয়সের কারণে তাঁরা ছুটে বেরোতে পারেননি। বাকি রাত সকলে কার্যত জেগেই কাটালাম। রবিবার ভোর সাড়ে চারটেয় আরও এক অনুভূব করলাম ভূমিকম্প। চার দিকে ফের আতঙ্ক আর ছোটাছুটি। তার মধ্যেও ঝাড়গ্রামের এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী অমিতাভ বসু মল্লিক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা রেণু সিংহ, গৃহবধূ অলকানন্দা মহাপাত্রর সাহস ও মনের জোর দেখে অবাক হয়েছি। ২৭ তারিখ গোরক্ষপুর এক্সপ্রেসে ফেরার টিকিট। ওই পরিস্থতিতেও সকলে বললেন, নির্ধারিত ট্রেনেই ফিরবেন। রবিবার সকালে লুচি আর তরকারি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম লুম্বিনী। কয়েক জন বললেন, সঙ্গে যখন গাড়ি আছে, বুদ্ধের জন্মস্থানটা দেখে যাই। কিন্তু দুপুরে সেখানে পৌঁছতেই ফের ‘আফটার শক’-এর কাঁপন। এক রাশ উদ্বেগ নিয়ে ফোন করছেন পরিজনেরা। বিকেলে ভারত সীমান্তের সুনৌলিতে পৌঁছলাম। স্থানীয় একটা হোটেলে উঠেছি। সোমবার সড়কপথ ধরে গোরক্ষপুর যাব। ট্রেন ধরে খড়্গপুর। বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ছে না।

(লেখক ঝাড়গ্রামের একটি ভ্রমণ সংস্থার মালিক)

Kuntal kumar dey panic attack earthquake Nepal Jhargram Kolkata Nepal earthquake
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy