Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
পৃথক ফল কেন, প্রশ্ন সেটাই

কলেজে চড়াও হয়ে হাজতে তৃণমূল বিধায়ক

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য এবং রাজনৈতিক নেতাদের দাদাগিরি সাম্প্রতিক কালে দেখা গিয়েছে বারবার। যত বারই গোলমাল হয়েছে, প্রায় প্রতি বারই ‘ছোট ছেলেদের কাণ্ড’ আখ্যা দিয়ে ‘সামান্য ঘটনা’ আড়াল করার চেষ্টা চালিয়েছেন শাসক দল তথা রাজ্য সরকারের শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা।

ফকিরচাঁদ কলেজ চত্বরে দীপক হালদার (চিহ্নিত)। সোমবার। — নিজস্ব চিত্র।

ফকিরচাঁদ কলেজ চত্বরে দীপক হালদার (চিহ্নিত)। সোমবার। — নিজস্ব চিত্র।

শান্তশ্রী মজুমদার
ডায়মন্ড হারবার শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৪১
Share: Save:

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্য এবং রাজনৈতিক নেতাদের দাদাগিরি সাম্প্রতিক কালে দেখা গিয়েছে বারবার। যত বারই গোলমাল হয়েছে, প্রায় প্রতি বারই ‘ছোট ছেলেদের কাণ্ড’ আখ্যা দিয়ে ‘সামান্য ঘটনা’ আড়াল করার চেষ্টা চালিয়েছেন শাসক দল তথা রাজ্য সরকারের শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা। সেই পরম্পরায় সোমবার ব্যতিক্রম দেখল রাজ্য! যখন ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজে ঢুকে গোলমাল বাধানোর অভিযোগে গ্রেফতার হলেন শাসক দলের স্থানীয় বিধায়ক দীপক হালদার!

শাসক দলের নানা স্তরের নেতা থেকে শুরু করে ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বারংবার অভিযোগ উঠলেও যাঁর ‘প্রশ্রয়ে’ শাস্তির খাঁড়া থেকে তাঁরা বেঁচে গিয়েছেন বলে এত দিন সরব ছিলেন বিরোধীরা, সেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই এ বার রাজধর্ম পালনে এগিয়ে এলেন। বাগডোগরা বিমানবন্দরে নেমে কালিম্পং যাওয়ার পথে কলেজে অশান্তির খবর পেয়েই নিজের দলের বিধায়ককে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন তিনি। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বার্তাও এ বার ক়়ড়া। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই ধরনের ঘটনা যে কোনও ভাবেই বরদাস্ত করা হবে না, বুঝিয়ে দিতে চাইছে সরকার। বিধায়ককে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’ সেই মতোই এ দিন সন্ধ্যায় রাজ্য পুলিশের আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা সংক্ষিপ্ত ঘোষণা করলেন, ‘‘ওঁকে (বিধায়ক) গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ আগামিকাল তাঁকে আদালতে তোলা হবে। কলেজে গোলমালের ঘটনায় ফারুক ঘরামি এবং আনোয়ার হোসেন নামে কলেজের দুই ছাত্রকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁদেরও কাল আদালতে তুলবে পুলিশ।


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন

শিক্ষাঙ্গনে ঢুকে বিধায়ক দাদাগিরি করছেন, পুলিশের সঙ্গে বচসা-ধাক্কাধাক্কিতে জড়িয়ে পড়ছেন এবং দ্রুত তাঁকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে— এমন ঘটনাকে স্বাগতই জানাচ্ছে শিক্ষা মহল। কিন্তু প্রশাসনের ‘কঠোর মনোভাবে’ এই স্বস্তির হাওয়া ছাপিয়েও বড় হয়ে উঠছে বিস্ময়! কোন জাদুতে পুলিশের জালে জড়িয়ে যেতে হল দীপকবাবুকে? যে দলে সাংসদ তাপস পাল, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, দোলা সেন, বিধায়ক মনিরুল ইসলাম বা বীরভূমের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের মতো একের পর এক নেতা বিবিধ কুকর্মে অভিযুক্ত হয়েও ছাড় পেয়ে যান, সেই দলেই দীপকবাবুর ক্ষেত্রে এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন? একের পর এক অভিযোগ পেয়েও যে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন নির্বিকার থাকে, তারাই এমন সক্রিয় হয়ে উঠল কেন ডায়মন্ড হারবারের ঘটনায়?

শাসক শিবির সূত্রেই উত্তর মিলছে, রহস্য আসলে লুকিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠী সমীকরণে! দক্ষিণ ২৪ পরগনার তৃণমূলে এখন যাঁদের প্রতাপ, তাঁদের সঙ্গে বনিবনা ছিল না দীপকবাবুর। বরং তাঁর নানা কাজকর্ম নিয়ে দলের ওই প্রভাবশালী অংশের কাছে নানা অভিযোগ জমা পড়ছিল। তার মধ্যে যেমন ডায়মন্ড হারবার বন্দরের কাজকর্ম ঘিরে আর্থিক লেনদেনের প্রশ্ন জড়িত, তেমনই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিজের লোক’ ঢোকানো নিয়ে টানাপড়েনও যুক্ত। তৃণমূলেরই একটি সূত্র বলছে, ডায়মন্ড হারবার বন্দরে মাল খালাসের শ্রমিক সরবরাহকারী সংগঠনের সভাপতি পদ থেকে দীপকবাবুকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল স্থানীয় সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে। বিধায়কের কাজকর্মে সাংসদ খুশি ছিলেন না। দলের একাংশের কাছ থেকে বিধায়ক সম্পর্কে ‘বিরূপ রিপোর্ট’ পাচ্ছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও। জেলায় প্রশাসনিক বৈঠকে উন্নয়নমূলক কাজকর্মের খতিয়ান নিতে গিয়েও ডায়মন্ড হারবারের বিধায়ককে মুখ্যমন্ত্রীর তিরস্কার প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে প্রশাসন সূত্রের খবর। শাসক দলেরই এক নেতার কথায়, ‘‘দীপক হালদারকে কোতলের চিত্রনাট্য তৈরিই ছিল! একটু বেচাল ঘটলেই তাঁকে জালে পড়তে হতো। এ দিন সেটাই ঘটেছে!’’ গ্রেফতারের নির্দেশ জারির আগে এ দিন শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবুর সঙ্গে কথা হয় মমতা এবং অভিষেক দু’জনেরই। অভিষেক অবশ্য গোটা ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। টেক্সট মেসেজেরও জবাব আসেনি।

দীপকবাবু নিজেও চিত্রনাট্যের তত্ত্বকেই সামনে এনেছেন। গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁর অভিযোগ, ‘‘আমাকে যাতে ভোটের টিকিট না দেওয়া হয়, তার চেষ্টাই করছে ওরা! পুলিশকেও ব্যবহার করা হচ্ছে।’’ তবে কার বিরুদ্ধে ইঙ্গিত করছেন তিনি, তা নিয়ে মন্তব্য করেননি বিধায়ক। তাঁর দাবি, ‘‘কলেজে মারপিট হয়েছে বলে খবর পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তো কাউকে মারধর করতে যাইনি। বরং সংঘর্ষ থামাতে গিয়েছিলাম।’’

সংঘর্ষ থামানোর ওই দাবি অবশ্য নস্যাৎ করে দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। পার্থবাবুর বক্তব্য, ‘‘দীপকবাবু ওই কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি। তিনি কলেজে যেতেই পারেন। কিন্তু সেখানে তিনি সমস্যা মেটানোর বদলে পরিস্থিতি অশান্ত করে তুলেছেন। তাঁর ভূমিকা একেবারেই এক জন জনপ্রতিনিধির মতো ছিল না! তৃণমূল নেতা হিসেবেও তাঁর ভূমিকা সমর্থনযোগ্য ছিল না।’’ কিন্তু এর আগে রায়গঞ্জ থেকে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, বহু জায়গাতেই তো শাসক সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ ছিল! তখন কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? পার্থবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘ধৈর্যেরও তো সীমা থাকে! প্রশাসন এই ধরনের ঘটনায় এখন থেকে কড়া ব্যবস্থা নেবে। আর শাসক দলের বিধায়ক যদি ছাড় না পান, তা হলে বিরোধীদেরও বুঝে নেওয়া উচিত, এই রকম আচরণ করলে তাঁদের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ হবে!’’

শিক্ষামন্ত্রীর এই ব্যাখ্যায় বিরোধীরা সন্তুষ্ট নন। তাঁরা বলছেন, যখনই তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরা বিরোধীদের হুমকি দিয়েছেন বা আক্রমণে মদত দিয়েছেন, অভিযুক্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু গোলমালের জেরে যখন আক্রান্ত হয়েছেন শাসক দলেরই লোকজন, তখন কোনও এক পক্ষের উপরে শাস্তির খাঁড়া নেমেছে। কলকাতায় বাইপাসের ধারে তৃণমূল কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাওকে গ্রেফতার, ভাঙড়ে দুই তৃণমূল কর্মী খুনের পরে প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলামকে বহিষ্কার বা এখন ডায়মন্ড হারবার কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের গোষ্ঠী-সংঘর্ষের ঘটনায় দীপকবাবুকে গ্রেফতার— তৃণমূল বনাম তৃণমূল হলেই কি ‘রাজধর্ম’ মনে পড়ে, প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা! জানতে চাইছেন, পুলিশ বা বিরোধী দলের উপরে হামলা হলে কি সাত খুন মাফ?

ডায়মন্ড হারবারের ঘটনায় আরও কিছু সংশয় রয়েছে বিরোধীদের। সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তীর দাবি, সম্ভবত দলেরই অন্য গোষ্ঠীর হাতে বিধায়কের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই পুলিশ হেফাজতে নিয়ে এলাকায় ক্ষোভ প্রশমনের পাশাপাশি আপাতত তাঁকে ‘সুরক্ষা’ দেওয়া হয়েছে! সুজনবাবুর আরও মন্তব্য, ‘‘শুধু তো গ্রেফতার করলেই হল না। এর পরে যদি তিনি সহজেই জামিন পেয়ে যান, তা হলে বুঝতে হবে এটা লোকদেখানো গ্রেফতার!’’ বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহেরও মন্তব্য, ‘‘সমাজবিরোধীদের নিয়ে চললে দলের উপরেও হামলা নেমে আসে। তৃণমূলের সেটাই হচ্ছে।’’

সিপিএম নেতা সুজনবাবুর ‘আশঙ্কা’ই দিনের শেষে সত্যি হয়েছে! রাত পর্যন্ত দীপকবাবুর বিরুদ্ধে কোন কোন ধারায় মামলা দেওয়া হবে, তা নিয়ে চাপে ছিলেন পুলিশ কর্তারা। কলেজের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রী ও কলেজের এক কর্মীর পৃথক অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে মারধর, হুমকি, মহিলাদের অপমান, অনধিকার প্রবেশ-সহ যে সব ধারা আনা হয়েছে, সবই জামিনযোগ্য বলে থানা সূত্রে জানা গিয়েছে।

এ দিন কলেজ অশান্তি নিয়ে দীপকবাবু এবং আর এক স্থানীয় তৃণমূল নেতা উমাপদ পুরকাইত পরস্পরের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন। অন্য গোষ্ঠীর দিকে পাল্টা অভিযোগের আঙুলও তুলেছেন দীপকবাবু। তা হলে শুধু তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কেন? পার্থবাবু বলেন, ‘‘অভিযোগ থাকতেই পারে। তৃণমূলের মহাসচিব হিসেবে সকলের কাছেই ফের অনুরোধ করছি, অভিযোগ থাকলে দলকে জানান। বিবৃতি দিয়ে দলকে হেয় করবেন না।’’

তৃণমূল ভবনে বৈঠক করে রবিবারই হাওড়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলে দলের একটি সূত্রের খবর। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এ দিন ফকিরচাঁদ কলেজে টিএমসিপি-র দুই গোষ্ঠীর মধ্যে গোলমাল বাধে। প্রথমে তৃণমূল কাউন্সিলর দেবকী হালদারের নেতৃত্বে এক দল যুবক কলেজের ইউনিয়ন রুমে ঢুকে দীপক-ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের মারধর করে। এক ঘণ্টা ধরে মারধর, ভাঙচুর সেরে বেরিয়ে যাওয়ার পরে আসে পুলিশ। তার মধ্যেই বাইকে চেপে আসেন বিধায়ক। সঙ্গে লাঠিসোঁটা নিয়ে আরও কিছু ছেলে। পুলিশ কেন সময় মতো ব্যবস্থা নেয়নি, কেন তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মারধর করল বহিরাগতরা, এই প্রশ্ন তুলে বিধায়ক পুলিশের দিকে তেড়ে যান। দীপকবাবুর দাবি, পুলিশ দর্শকের ভূমিকায় ছিল। পুলিশ, র‌্যাফ, কমব্যাট ফোর্স মিলিয়ে তখন কলেজে যে জনা তিরিশ ছিলেন নিরাপত্তার দায়িত্বে, তাঁরা হিমসিম খান বিধায়ককে সামলাতে! বিকেলের দিকে হাসপাতালে অনুগামীদের দেখতে যান বিধায়ক। ইতিমধ্যে ডায়মন্ড হারবার থানার আইসি দীপকবাবুকে জানান, তাঁকে গ্রেফতার করার নির্দেশ এসেছে ‘উপর’ থেকে। তত ক্ষণে বিধায়কের ফোনেও দলের এক শীর্ষ নেতার বার্তা এসে গিয়েছে। তাঁকে যে গ্রেফতার করা হবে, আঁচ পেয়েই গিয়েছিলেন দীপকবাবু। তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ যখন, আমি অবশ্যই পালন করব।’’

বিধায়ককে গাড়িতে তুলে পুলিশ হাসপাতালের বাইরে আসার সময়ে তাঁর কিছু অনুগামী গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েন। বিধায়ক তাঁদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিজেই পুলিশের কাজ সহজ করে দেন। গ্রেফতারের প্রতিবাদে পরে কিছু জায়গায় পথ অবরোধও হয়। থানার সামনেও ধর্নায় বসেন অনেকে। যে খবর শুনে তৃণমূলেরই এক নেতা বলছেন, ‘‘২০১৬-য় টিকিটটা মনে হচ্ছে কাটাই গেল!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE