পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে এক নাগাড়ে কেঁদে চলেছেন অমিছা বিবি। গ্রামের লোকজন ভিড় করে আছেন চারিদিকে। সারা রাত ধরে এ ভাবেই ভিড় করেছিলেন তাঁরা। কারও আর ঘুম হয়নি রাতে। নাওয়া-খাওয়া যেন সব ভুলে গিয়েছে মশালডাঙা ছিটমহলের বাসিন্দারা।
একদিনেই ছবিটা বদলে গিয়েছে সেখানে। উচ্ছ্বাস-আনন্দ বদলে গিয়েছে বিষাদে। শনিবার তখন রাত সাড়ে ১০টা। একদল দুষ্কৃতী সশস্ত্র অবস্থায় হামলা চালায় দিনহাটার বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া মশালডাঙা ছিটমহলে। স্থল সীমান্ত চুক্তিতে সই হওয়ার পর যা এখন ভারতেরই অংশ। একটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় দুষ্কৃতীরা। ঘরের ভিতরে ঢুকে জিনিসপত্র লুঠ করে নিয়ে যায়। এর পর থেকেই ওই গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এক দুষ্কৃতীকে স্থানীয় জনতা আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশ জানায় ধৃতের নাম, বিপ্লব বর্মন।
রবিবার সকালে ওই গ্রামে যান কোচবিহারের পুলিশ সুপার রাজেশ যাদব এবং দিনহাটার মহকুমাশাসক কৃষ্ণাভ ঘোষ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও ওই গ্রামে যান। পুলিশ সুপার জানান, ওই গ্রামে পুলিশ টহলদারি রয়েছে। একটি স্থায়ী ক্যাম্প বসানো হবে। তিনি বলেন, “মদ্যপ অবস্থায় থাকা এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত শুরু করা হয়েছে। কেউ কোনও গণ্ডগোলের চেষ্টা করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” মহকুমাশাসক স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বসে বৈঠক করেন। তিনি বৈঠকে বাসিন্দাদের উদ্দেশে বলেন, “ভয় পাবেন না। আমরা পাশে আছি। আপনারা এখন ভারতীয় বাসিন্দা। আমার যা অধিকার আছে। আপনারও সেরকম অধিকার আছে। আইন নিজের হাতে নেবেন না। কেউ কোনওরকম গণ্ডগোলের চেষ্টা করলে আমাদের জানান। আমরা ব্যবস্থা নেব।” মহকুমাশাসক ওই এলাকায় রাত পাহারায় নামতে বলেন স্থানীয় বাসিন্দাদের। পুলিশের সঙ্গে পালা করে রাত পাহারা দেবেন বাসিন্দারা।
ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটির নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্তের অভিযোগ, ছিটমহলে দুস্কর্মের সঙ্গে যুক্ত একদল দুষ্কৃতী বিভিন্ন গন্ডগোল তৈরির চেষ্টা করছে। তিনি পাঁচ জায়গায় পুলিশ ক্যাম্প তৈরির জন্য প্রশাসনের কাছে আবেদন করেন। তিনি বলেন, “ছিটমহলের কোনও বাসিন্দার উপরে যাতে কোনওরকম হামলা না হয় সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছি প্রশাসনের কাছে। পুলিশ-প্রশাসনের তরফে আমাদের সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।”
মধ্য মশালডাঙা ছিটমহলে আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘর দেখতে ঘটনাস্থলে পুলিশ। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।
ওইদিন কী হয়েছিল গ্রামে? পুলিশ সূত্রের খবর, ৬ জুন স্থল সীমান্ত চুক্তি হওয়ার পর থেকে ছিটমহলগুলিতে আনন্দে মেতে ওঠেন বাসিন্দারা। ৭ জুন মশালডাঙ্গা ছিটমহলে ১৯ টি ছিটের বাসিন্দাদের নিয়ে উৎসবের আয়োজন করা হয়। উৎসবের শোভাযাত্রা এলাকায় ঘোরার সময় বটতলা এলাকায় স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা মিছিল আটকে দেয়। মিছিলের অনুমতি আছে কি না তা জানতে চান তাঁরা। সে সময় দুই পক্ষের মধ্যে বচসা তৈরি হয়। ছিটমহলের বাসিন্দারা উত্তেজনা তৈরির আশঙ্কায় পিছিয়ে যায়। অভিযোগ, রাত পড়তেই মশালডাঙার দিকে বড় বড় বেশ কয়েকটি টর্চের আলো ফেলতে শুরু করে কিছু দুষ্কৃতী। এরপরেই রাত সাড়ে ১০ টা নাগাদ ২০-২৫ জনের একটি দল ছিটমহলের ভিতরে ঢুকে হামলা চালায়। সুকুর আলির বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে। বাধা দিতে গেলে তাঁদের ভয় দেখানো হয়। ঘর থেকে তিনটি সাইকেল, একটি টেলিভিশন, বেশ কয়েক মন ধান নিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। যাওয়ার আগে একটি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই সময় ছিটমহলের বাসিন্দারা দল বেঁধে দুষ্কৃতীদের তাড়া করলে একজনকে ধরে ফেলে। তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। স্থানীয় কর্মীদের দাবি, ওই যুবক তৃণমূল কর্মী। এদিন ওই এলাকায় যান দিনহাটা ২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি করবী রায়, স্থানীয় জেলা পরিষদ সদস্য তরণী বর্মন। সভাপতির হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে অছিমা বিবি বলেন, “আমার বাড়িতে এই নিয়ে তিনবার লুঠ করা হল। এবারে ভাবলাম বোধহয় আর গণ্ডগোল হবে না। এখন কি করে বেঁচে থাকব।” সভাপতি তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, “চিন্তা করবেন না। আর কেউ কিছু করতে পয়ারবে না। আমরা পাশে আছি।” তরণীবাবু বলেন, “রাজনীতির সঙ্গে এই ঘটনার কোনো মিল নেই। এখন তো অনেকেই তৃণমূল করে। ছিটমহলের বাসিন্দাদের উপরে যাতে কোনও হামলা না হয় সেদিকে আমরা লক্ষ্য রাখছি।”