বাজেট অধিবেশনের আগে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে নবান্ন ও বিধানসভা উভয়ের দ্বন্দ্ব পাকিয়ে উঠেছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনড় অবস্থান নিয়ে সোমবার রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যপাল চাইলেও মন্ত্রিসভার অনুমোদিত বয়ানের একটি শব্দও বদল করা হবে না। এই ভাষণই রাজ্যপালকে পড়তে হয়, সেটাই সাংবিধানিক রীতি। অন্য দিকে, বিধানসভা চত্বরে বিধায়কদের জন্য মোতায়েন কেন্দ্রীয় নিরাপত্তারক্ষীদের প্রবেশ বন্ধ করা নিয়ে রাজ্যপালের আপত্তির জবাবে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁকে বলে দিয়েছেন, বিধানসভার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্পিকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এ ক্ষেত্রে রাজ্যপাল হস্তক্ষেপ করতে চাইলে তা হবে ‘অনধিকার চর্চা’। এমনই আবহে আগামী ২ জুলাই রাজ্যপালের ভাষণ দিয়েই শুরু হতে চলেছে বাজেট অধিবেশন।
সরকারের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিন কোনও না কোনও বিষয়ে রাজ্যপাল আক্রমণ শানাচ্ছেন। ফলে, বাজেট অধিবেশনে তাঁর বক্তৃতার বয়ান নিয়ে তিনি যে প্রশ্ন বা আপত্তি তুলতে পারেন, সেই আশঙ্কা সরকারের ছিল। এরই মধ্যে ধনখড় নবান্নকে হাতে লেখা নোটে জানিয়ে দেন, ভাষণের কপি তাঁর কাছে ‘যথেষ্ট সময়’ হাতে রেখে পাঠাতে হবে। যাতে তিনি তা পড়ে ‘বিবেচনা’ করতে পারেন। তখন থেকেই নবান্নের মনোভাবও কঠোর হচ্ছিল। বিষয়টি গুরুতর মাত্রা পায় এ দিন। উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরেই এ দিন রাজ্যপাল চিঠি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে বলেন, ভাষণের বয়ান নিয়ে আলোচনার জন্য আজ, মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী যেন রাজভবনে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। মমতা এর পরে সরাসরি ফোন করেন ধনখড়কে। সূত্রের খবর, মন্ত্রিসভার অনুমোদিত বয়ান যে বদল হবে না, সে কথা জানানোর পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘আমরা জনগনের দ্বারা নির্বাচিত। রাজ্যপালের ক্রীতদাস নই! সাংবিধানিক রীতি মেনে মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যপাল ডাকতেই পারেন। কিন্তু সব সময় তাঁর সুবিধা মতো বেঁধে দিলেই মুখ্যমন্ত্রীকে তা মান্য করতে হবে, ব্যাপারটা এমন নয়। এটা পারস্পরিক সুবিধা অনুযায়ী ঠিক হতে পারে।’’
পাশাপাশি, রাজ্যপালের সাম্প্রতিক সপারিষদ উত্তরবঙ্গ সফর, সেখানে বিজেপির লোকজনের সঙ্গে বৈঠক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ভূমিকা নিয়েও নানা অসন্তোষ ব্যক্ত করেন মুখ্যমন্ত্রী। সূত্রের খবর, ধনড়কে কার্যত ‘বিজেপির লোক’ বলতেও কসুর করেননি মমতা। রাজ্যপাল অবশ্য বলতে থাকেন, তিনি সংবিধান মেনে চলেন। পক্ষপাতদুষ্ট নন।
পরে মমতার মন্তব্য, ‘‘মঙ্গলবার রাজ্যপালের কাছে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। অন্য কোনও দিন যেতে পারি। তিনি চা খেতে ডাকলে যাব। তবে ওই ভাষণ নিয়ে কোনও রকম আলোচনার আবকাশ নেই। তা ছাড়া, মন্ত্রিসভার অনুমোদিত ভাষণের একটি শব্দও বদল করার এক্তিয়ার মুখ্যমন্ত্রীর থাকে না।’’
ধনখড় অবশ্য পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘সরকার বা মন্ত্রিসভা যে ভাষণের বয়ান তৈরি করে দেবে, তা হুবহু রাজ্যপালকে মেনে নিতে হবে— এমন কথা সংবিধানের কোথায় লেখা আছে?’’ তাঁর দাবি, ‘‘ভাষণে কোথাও যদি সাংবিধানিক দায়িত্ব বা কর্তব্যের বিচ্যুতি থাকে, রাজ্যপাল তা চিহ্নিত করতেই পারেন। তার পরে কী পদক্ষেপ হতে পারে, তা এখনই বলতে চাই না।’’ রাজ্যপালের বক্তব্য, সরকারের পাঠানো ভাষণের কিছু অংশ নিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা চেয়েছেন এবং আজ মুখ্যমন্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করবেন। ধনখড়ের মতে, ‘‘গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই হল আলোচনা। ভিন্ন মত থাকা মানেই সংঘাত নয়। আমি সংঘাত চাই না, আগেও বলেছি আমি সরকারের পক্ষে।’’
কেন্দ্রীয় নিরাপত্তারক্ষীদের প্রবেশে আগেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন স্পিকার বিমানবাবু। বিজেপি বিধায়কেরা প্রায় সবাই এখন কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে চলা ফেরা করেন। স্পিকার মনে করেন, এত সংখ্যক বিধায়কের সঙ্গে যদি কেন্দ্রীয় বাহিনী ঢুকতে থাকে, তা হলে যে অবস্থা সৃষ্টি হবে, সেটা স্থান সঙ্কুলান বা অন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার পরিপন্থী। সেই নির্দেশকেই খারিজ করতে চেয়ে সম্প্রতি স্পিকারকে চিঠি দিয়েছিলেন রাজ্যপাল। সেই চিঠির জবাবে স্পিকার ফের জানিয়ে দেন, তাঁর সিদ্ধান্ত তিনি বহাল রাখছেন। যে হেতু এটা বিধানসভার অভ্যন্তীরণ বিষয় স্পিকারের সিদ্ধান্ত সেখানে চূড়ান্ত। এ দিনই স্পিকার জানিয়ে দিয়েছেন, প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তরক্ষীদের জন্য বিধানসভার বাইরে ব্যবস্থা করা হবে।
শুধু বিধানসভা ঘিরেই সংঘাত নয়, রাজ্যপালের সাম্প্রতিক উত্তরবঙ্গ সফর ঘিরে প্রশ্ন তুলে নবান্নে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, ধনখড় ‘রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করার খেলা’য় মেতেছেন! মমতার বক্তব্য, ‘‘এই রকম রাজ্যপাল আগে কখনও দেখিনি। তিনি যত দিন থাকবেন, সংবিধান মেনে দেখা করব, কথা বলব, এটা সৌজন্য। তবে তাঁকে যাতে সরিয়ে দেওয়া হয়, তার জন্য আমি তিনটি চিঠি দিয়েছি। কেন্দ্রের এটা ভেবে দেখা উচিত জেদাজেদি না করে।’’
পরে রাজভবনে ধনখড় বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছেন, বলেছেন। তার পরে কী হয়েছে, সেটা কেন্দ্রীয় সরকারের এক্তিয়ার, তারাই বলতে পারবে।’’ রাজ্যপালের দাবি, উত্তরবঙ্গে তিনি কোনও ‘উস্কানি’ দিতে যাননি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বহু সংগঠন এবং ব্যক্তি আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। জিটিএ-র কাজকর্ম নিয়ে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। জিটিএ দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের আখড়া হয়ে উঠেছে বলে গুরুতর অভিযোগ আছে। তার জন্য সিএজি-র অডিটের কথা বলেছি। এর মধ্যে অসাংবিধানিক কী আছে?’’