পাঁচ বছরে ৬৮ লক্ষ। তৃণমূল আমলে কর্মসংস্থানের এই দাবি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল বিরোধীরা। রাজ্যপালের ভাষণের উপর ধন্যবাদজ্ঞাপক প্রস্তাব বিতর্কে জবাবি ভাষণ দিতে উঠে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, কোন ক্ষেত্রে কত চাকরি হয়েছে তার সবিস্তার হিসেব দেবেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। সোমবার বিধানসভায় অর্থ বিলের জবাবি ভাষণে সেই হিসেব পেশ করলেন অমিতবাবু। কিন্তু বিতর্ক মিটল না।
সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্র ধরে গত পাঁচ বছরে ৬৮ লক্ষ কর্মসংস্থানের হিসেব অবশ্য মিলিয়ে দিয়েছেন অমিতবাবু। তাঁর দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, সরকারি এবং সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান হয়েছে ৪০ লক্ষের বেশি। অসংগঠিত ক্ষেত্রে ২৮ লক্ষ। সব মিলিয়ে গড়ে বছরে প্রায় সাড়ে তেরো লক্ষ। বাম শিবিরের দাবি, তাঁদের আমলেও কর্মসংস্থানের হার মোটামুটি এই রকমই ছিল। ফলে অমিতবাবুর দেওয়া অঙ্ক সত্যি হলেও তৃণমূলের বাড়তি সাফল্যের দাবি ধোপে টেকে না। যদিও কর্মসংস্থানের এই দাবি কতটা সত্যি তা নিয়ে এখনও সংশয়ী বিরোধীরা। অমিতবাবু অবশ্য বলেছেন, ‘‘এই পরিসংখ্যান পুরোটাই সরকার নিজে তৈরি করেছে। এর মধ্যে কোনও জল নেই।’’
রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘গত পাঁচ বছরে রাজ্যে কোনও বড়-মাঝারি শিল্পই হল না। তা হলে সংগঠিত ক্ষেত্রে ৩৬ লক্ষ মানুষ কাজ পেল কী করে! আর যদি চার লক্ষ সরকারি কর্মচারী নিয়োগ হয়ে থাকে তা হলে ২০১৫-’১৬ সালে বেতন খাতে সরকারের খরচ ৩৩ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা থেকে কমে ৩২ হাজার ৯১১ কোটিতে দাঁড়াল কী করে? যাঁরা চাকরি পেয়েছেন তাঁরা কি বিনা বেতনে কাজ করছেন?’’
খানিকটা সংশয়ী অর্থনীতিবিদরাও। আইআইএম–কলকাতার অর্থনীতির শিক্ষক অনুপ সিংহের বক্তব্য, ‘‘যা হিসেব দেওয়া হয়েছে, তাতে গত পাঁচ বছরে গড়ে প্রতি মাসে এক লক্ষের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তার মধ্যে ৬০%-এর বেশি সংগঠিত ক্ষেত্রে। এই তথ্যে আমার একটু সংশয় হচ্ছে।’’ কেন, তার ব্যাখ্যা দিয়ে অনুপবাবু বলেন, ‘‘রাজ্যের যা পরিস্থিতি তাতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে বেশি কাজ তৈরি হলে সেটাই বাস্তবোচিত হতো। কিন্তু সংগঠিত ক্ষেত্রে এত কর্মসংস্থান হওয়ার অর্থ রাজ্যের আর্থিক কারবার ভালই চলছে। বড়-মাঝারি শিল্প বহুল পরিমাণে আসছে। যদি এমন হয়ে থাকে, তা হলে সরকারের এ নিয়ে আরও প্রচার করা উচিত।’’
আরও একটা মৌলিক প্রশ্ন অর্থনীতিবিদরা তুলছেন। সেটা হল, প্রতি বছর কর্মসংস্থান যেমন হয়, তেমনই কিছু মানুষ কাজও হারান। এই দুই সংখ্যার ফারাক থেকে নিট কর্মসংস্থানের হিসেব মেলে। এ ক্ষেত্রে সেটা কী? সেটাই তো কর্মসংস্থানের প্রকৃত চিত্র। ঘটনা হল, বাম আমলের মতো তৃণমূল সরকারও সেই হিসেবে যায়নি। যদিও অমিতবাবুর দাবি, ‘‘এটাই নিট কর্মসংস্থান ধরতে হবে, কারণ এই সময়ে কাজ হারিয়েছেন এমন মানুষ হাতে গোনা। তাঁরা একটি কাজ ছেড়ে অন্য কাজে গিয়েছেন। ফলে কাজহারা মানুষ রাজ্যে নেই।’’
অর্থনীতিবিদদের আরও প্রশ্ন হল, কর্মসংস্থানের এই পরিসংখ্যান সরকার কোথা থেকে পেয়েছে? এটা কি তৃতীয় কোনও সংস্থার তৈরি, নাকি সরকার হিসাব মেলাতে মনগড়া তথ্য পেশ করেছে? বিশেষ করে, অসংগঠিত ক্ষেত্রে যে ২৮ লক্ষের মানুষ কাজ পেয়েছে বলে সরকার দাবি করেছে, তার ভিত্তি কী? কারণ, অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রামাণ্য তথ্য পাওয়াটাই বেশ মুশকিলের।
অর্থমন্ত্রী অবশ্য মনে করেন যে, সংশয়ের কোনও অবকাশই নেই। তিনি জানান, সরকারি চাকরি বা শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠা অনুচিত। সরকার এঁদের বেতন দেয়। সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মসংস্থানের তথ্যও খাঁটি। ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্প, বড়-মাঝারি দোকান, স্বনির্ভর দল এবং বিভিন্ন সমবায় সমিতির মাধ্যমে এই কর্মসংস্থান হয়েছে। তাদের সব কিছু পঞ্জিকরণ করতে হয় বলেই সরকার তথ্য পেয়েছে। আর অসংগঠিত ক্ষেত্রের তথ্যও যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে করা হয়েছে দাবি করে অর্থমন্ত্রী জানান, গত পাঁচ বছরে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বহু গুণ খরচ করেছে সরকার। ফলে পরিকাঠামো ও নির্মাণ শিল্পে যে বিপুল কর্মসংস্থান হয়েছে। এ ছাড়া, হাউস কিপিং, নিরাপত্তা রক্ষী, মৎস্যচাষ, সব্জি বিক্রেতা, হকার, খাদি উদ্যোগ-সহ বিবিধ ক্ষেত্র ধরলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মসংস্থান মোটেই অবাস্তব নয় বলে অমিতবাবুর দাবি।
অর্থমন্ত্রীর কথায়, ‘‘যোজনা কমিশনের ‘আউটপুট এমপ্লয়মেন্ট ইলাস্টিসিটি’ মানকের বিচারে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান হওয়ার কথা, তার চেয়ে কিছু কমই কাজ তৈরি সম্ভব হয়েছে।’’ তবে একই সঙ্গে
তাঁর বক্তব্য, কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যানে একশো দিনের কাজের হিসেব ধরা হয়নি। সেটা ধরা হলে কাজের সুবিধা পাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি হতো। কারণ, গত পাঁচ বছরে ১৯ হাজার কোটি খরচ করে ১০৮ কোটি ৫৫ লক্ষ শ্রমদিবস তৈরি করা গিয়েছে।
অমিতবাবুর এই দাবি অবশ্য বিরোধীদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কংগ্রেস বিধায়ক তথা রাজ্য অর্থ কমিশনের প্রাক্তন প্রধান সুখবিলাস বর্মা বলেন,‘‘বাজেট তৈরি থেকে পরিসংখ্যান সবই গোঁজামিল দিয়ে চলছে। এই সরকার সবই বাড়িয়ে বাড়িয়ে দেখায়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy