আনজুয়ারার শেষ যাত্রায় গ্রামের মানুষের ভিড়। রবিবার নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।
সেটা ১৯৯২ সালের কথা। বনগাঁ-বাগদা সড়কের ধারে জখম হয়ে পড়েছিলেন পথ দুর্ঘটনায় আহত এক ব্যক্তি। আশপাশে লোক জড়ো হয়ে বিস্তর ‘আহা-উহু’ করলেও কেউই আহত ব্যক্তিকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার উদ্যোগ করছিলেন না। খবর পেয়ে ছুটে আসেন গাঁয়ের বধূ আনজুয়ারা বিবি। তিনিই পাঁজাকোলা করে গাড়ি ডেকে সেই ব্যক্তিকে নিয়ে যান বনগাঁ হাসপাতালে। বিস্ফারিত চোখে সে দিন গ্রামের পাঁচ জন দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন তরুণী বধূর তৎপরতা।
সেই শুরু। আনজুয়ারা বিবিকে তারপর থেকে অন্য রূপে দেখতে শুরু করেন বনগাঁর চাঁদার বাসিন্দারা। মানুষের আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়াতে এক পায়ে খাড়া আনজুয়ারা।
ছাদ থেকে পড়ে কিছু দিন চিকিৎসাধীন থেকে মারা গিয়েছেন তিনি। গোটা গ্রাম এ দিন ভেঙে পড়েছিল তাঁর বাড়ির সামনে। এমন কাউকে দেখা গেল না, যাঁর চোখে জল নেই। বহু বাড়িতে অরন্ধন হয়েছে এ দিন।
গাইঘাটার রাজাপুরে আনজুয়ারার বাপের বাড়ি। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বিয়ে হয়েছিল চাঁদার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম মণ্ডলের সঙ্গে। এএ দিন গাইঘাটার বাড়ি থেকে আনজুয়ারার দেহ আশে চাঁদায়। গ্রামে ঢোকার মুখে মানুষের ভিড়ে বনগাঁ-বাগদা সড়ক তখন প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। মহিলাদের কান্নার রোল বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
আনজুয়ারা নিজে চিরকালই প্রচার বিমুখ। কারও উপকারে এলে তা নিয়ে আলোচনা বিশেষ পছন্দ করতেন না। কিন্তু তিনি বললেই তো হল না। গাঁয়ের লোকের মুখে মুখে ফিরছে তাঁর কাজের কথা।
কথা হচ্ছিল সতীশ সূত্রধরের সঙ্গে। বললেন, ‘‘আমার শরীর খুব খারাপ ছিল। ভাবি (আনজুয়ারা) খবর পেয়েই চলে আসেন বাড়িতে। চিকিৎসার টাকা নেই শুনে নিজেই টাকা দেন। সঙ্গে করে নিয়ে যান কলকাতার হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরি। ওঁর কথা ভোলার নয়।’’
মাটিতে আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়ে কাঁদছিলেন সরস্বতী পাইক। কোনও মতে বললেন, ‘‘খবর শুনে বাড়িতে আর থাকতে পারছিলাম না। বুকটা ফেটে যাচ্ছে।’’ সামসের আলি মণ্ডল নামে আনজুয়ারার এক আত্মীয় জানালেন, জাত-ধর্মের ব্যাপারে কখনও মাথা ঘামাতেন না উনি। যে কোনও মানুষ সমস্যায় পড়েছেন শুনলেই ছুটে যেতেন।
কোথা থেকে পেতেন এত শক্তি?
আনজুয়ারা নিজে বলতেন, ঠাকুর্দা রমজান আলি মণ্ডলই তাঁর অনুপ্রেরণা। তাঁর ছিল ছোট একটা মুদির দোকান। কিন্তু ছোটবেলায় আনজুয়ারা দেখেছেন, দরিদ্র মানুষকে কখনও খালি হাতে ফেরাননি দাদু। অনেককে বিনা পয়সায় মালপত্র দিয়ে দিতেন। তাতেই সসার চলত গ্রামের অনেকের। এ ছাড়াও গ্রামের মানুষের আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়াতেন দাদু। তিনিই কালে কালে হয়ে ওঠেন আনজুয়ারার অনুপ্রেরণা।
তবে নিজের কাজে স্বামীকে সব সময় পাশে পেয়েছেন আনজুয়ারা। নজরুল-আনজুয়ারার দুই ছেলে। বড় জন আনোয়ার হোসেন মণ্ডল কাজ করেন সেনাবাহিনীতে। ছোট আখতার চাকরির চেষ্টা করছে। নজরুল বলেন, ‘‘রাতবিরেতেও লোকের দরকার পড়লে স্ত্রী ছুটে যেতেন। আমার অনুমতি নিতেন ঠিকই। কিন্তু কোনও কাজে কখনও ওঁকে বাধা দিইনি।’’ দীর্ঘ দাম্পত্যের স্মৃতিচারণা করতে করতে নজরুল বলেন, ‘‘কত দিন হয়েছে, চাষের কাজ সেরে বাড়ি ফিরে দেখেছি, স্ত্রী বাড়ি নেই। কাউকে নিয়ে হয় তো হাসপাতালে বেরিয়ে গিয়েছে। সংসারের কথা তখন ওঁর মাথায় থাকত না। আমিই ভাত-আলুসিদ্ধ চাপিয়ে দিতাম।’’ কিন্তু হাসিমুখেই সে সব দায়িত্ব এত দিন সামলেছেন নজরুল, জানাচ্ছেন গ্রামের আরও অনেকে।
গ্রামের মানুষ এ দিন আরও অনেক কথা বলছিলেন প্রিয় মানুষটির কর্মজীবন নিয়ে। ২০০০ সালে বন্যায় তখন গোটা বনগাঁ জলের তলায়। মানুষ গাছে-গাছে আশ্রয় নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। মুখে জলটুকু তোলার সুযোগ নেই। সেই পরিস্থিতিতেও খিচুড়ি রান্না করে নৌকো নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন আনজুয়ারা। গলা-জল পেরিয়ে মানুষের হাতে তুলে দিতেন খাবার-জল।
মমতা বিশ্বাস বললেন, ‘‘গ্রামের হেন কোনও মানুষ নেই, যিনি কোনও না কোনও সময়ে আনুজায়ারা ভাবির কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাননি।’’ নেপাল বালা জানালেন, বিনামূল্যে চশমা পেয়েছিলেন আনজুয়ারার উদ্যোগে হওয়া গ্রামের স্বাস্থ্যশিবিরে। অজিতকুমার পাল নামে আর এক গ্রামবাসী জানালেন, টাকার অভাবে বাঁশ কিনে পানের বরজ বানাতে পারছিলেন না। ‘ভাবি’ জানতে পেরে নিজের জমি থেকে বাঁশ কেটে নিয়ে যেতে বলেছিলেন।
বনগাঁ হাসপাতালের চিকিৎসক গোপাল পোদ্দার বিলক্ষণ চিনতেন আনজুয়ারাকে। জানালেন, অনেক সময়েই রোগী নিয়ে আসতে দেখেছেন হাসপাতালে। কুশল বিনিময় হত। ডাক্তারবাবুর কথায়, ‘‘এমন মানুষ আজকাল খুঁজে পাওয়া সত্যি মুশকিল।’’
আনজুয়ারার মৃত্যুতে আতান্তরে পড়েছেন সানারা মণ্ডল। চোখের জল বাঁধ মানতে চাইছিল না তাঁর। কোনও মতে জানালেন, স্বামীর মৃত্যুর পরে তিন ছোট ছেলেকে নিয়ে বেঁচে-বর্তে আছেন। যার পিছনে ‘ভাবি’র সাহায্য অনেকটাই। এমন মানুষটি অকালে চলে যাওয়ার পরে কে তাঁদের দেখবে, ভাবনায় পড়েছেন দুঃস্থ পরিবারের বধূটি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy