E-Paper

লাথি হোক বা কামড়, পুলিশের মনের যত্ন নেওয়া হয় কি?

যে কলকাতা পুলিশের তুলনা হত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে, আজ তাদের কর্মদক্ষতায় কি মরচে ধরেছে? কারণ খুঁজে দেখল আনন্দবাজার।

চন্দন বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২৫ ০৯:২৬
পুলিশকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি কি আদৌ খতিয়ে দেখা হয়?

পুলিশকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি কি আদৌ খতিয়ে দেখা হয়? —প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।

আউটপোস্ট থেকে উর্দি পরে বেরিয়ে আসছেন এক পুলিশকর্মী। কাঁধে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। চোখে-মুখে অস্থিরতার লেশমাত্র নেই। কিন্তু আচমকাই কাঁধের রাইফেল হাতে নিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করলেন তিনি। ওই দৃশ্য দেখে তখন যুগপৎ ভয়ে ও বিস্ময়ে স্তম্ভিত আশপাশের পথচারীরা। ঠিক কী ঘটছে, বুঝে উঠতেই কয়েক মুহূর্ত লেগে গেল তাঁদের। তার পরে যে যে দিকে পারলেন, দৌড়ে পালালেন। যদিও রাইফেল থেকে ছিটকে আসা গুলি তত ক্ষণে ফুঁড়ে দিয়েছে এক মহিলা পথচারী-সহ কয়েক জনের শরীর। ২০২২ সালের জুন মাসে পার্ক সার্কাসের লোয়ার রেঞ্জের এই ঘটনায় পথচারী মহিলার মৃত্যু হয়েছিল। সে দিন নির্বিচারে কিছু ক্ষণ গুলি চালানোর পরে সার্ভিস রাইফেলটি নিজের দিকে তাক করে ট্রিগার টিপে দিয়েছিলেন সেই পুলিশকর্মী। ফলে, মারা যান তিনিও। ভয়াবহ এই ঘটনার পরে প্রশ্ন উঠেছিল, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ধরিয়ে দেওয়ার আগে পুলিশকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি কি আদৌ খতিয়ে দেখা হয়?

লালবাজারের তরফে সে সময়ে নিচুতলার পুলিশকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখার ব্যাপারে কিছু নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে কি পরিস্থিতি পাল্টেছে? মানসিক স্বাস্থ্য প্রভাব ফেলছে না তো পুলিশি তদন্তে?

লালবাজারের কর্তারা মুখে বার বার বাহিনীর মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে খেয়াল রাখার কথা বললেও ডিউটির চাপে ক্লান্ত নিচুতলার কর্মীরা যে তার কোনও সুফল পান না, তা তাঁদের সঙ্গে কথা বললেই পরিষ্কার হয়ে যায়। অনেকেরই অভিযোগ, এর পিছনে লালবাজারের প্রকৃত সদিচ্ছার অভাবের পাশাপাশি, নিচুতলার পুলিশকর্মীদের একাংশও দায়ী। তাঁদের অনেকেই নাকি কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘পুলিশের আবার মনের রোগ থাকতে আছে নাকি? ও সব নিয়ে ভাবতে গেলে থানার কাজ মাথায় উঠবে!’’

১৫০ বছরেরও বেশি পুরনো কলকাতা পুলিশ এলাকার বেশির ভাগটাই শহরকেন্দ্রিক। এখানে এক দিকে অপরাধের তদন্ত, অন্য দিকে ‘মিছিল-নগরী’ কলকাতায় নিত্যদিন লেগে থাকা আন্দোলন, মিছিল, জনসভার ভিড় সামলাতে হয় লালবাজারকে। কলকাতা পুলিশের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত এক জন বলছেন, ‘‘ভিড় নিয়ন্ত্রণে কী কী করণীয়, সেই কৌশল শেখানো হয় প্রশিক্ষণ শিবিরে। প্রথমে বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভ প্রশমনের উপরে জোর দিই আমরা। তাতে কাজ না হলে প্রয়োজনে ব্যারিকেড করে মিছিল রুখে দেওয়া হয়। আর কোনও উপায় না থাকলে এবং একান্তই প্রয়োজন হলে তবেই বলপ্রয়োগের রাস্তায় হাঁটার কথা বলা হয় প্রশিক্ষণে।’’

কিন্তু বাস্তবে ‘প্রশিক্ষিত’ পুলিশকর্মীরাও কি তা মানেন? মাসখানেক আগেই কসবায় দেখা গিয়েছিল, বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে চাকরি হারানো এক স্কুলশিক্ষকের বুকে লাথি মারছে পুলিশ। কলকাতা পুলিশের এ হেন আচরণ বিস্মিত করেছিল অনেককেই। পুলিশের প্রশিক্ষণেই ঘুণ ধরে গিয়েছে কিনা, প্রশ্ন উঠেছিল তা নিয়েও। যদিও লালবাজারের কর্তারা অভিযোগ মানতে চাইছেন না। উল্টে এক পুলিশকর্তার সাফাই, ‘‘কলকাতা পুলিশের বিশাল বাহিনী। দু’-এক জনের আচরণ দিয়ে গোটা বাহিনীর মূল্যায়ন করা যায় না।’’ তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘বাহিনীর এত খামতি থাকলে কলকাতা দেশের মধ্যে নিরাপদতম শহরের শিরোপা পেত কি?’’

কলকাতা পুলিশের প্রশিক্ষণের সঙ্গে দীর্ঘকাল যুক্ত থাকা, সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সুদর্শন দাস জানাচ্ছেন, শুধুমাত্র মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখতেও ব্যবস্থা থাকে প্রশিক্ষণে। মানসিক স্বাস্থ্য কী ভাবে ভাল রাখা যায়, তার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ‘ইন-সার্ভিস’ কর্মীদেরও। উদাহরণ হিসাবে সুদর্শন জানান, বছর কয়েক আগে কলকাতা পুলিশের এক মহিলা কর্মীর বিরুদ্ধে এক আন্দোলনকারীর হাত কামড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনার পরে এক মাস ফের পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে ওই মহিলা কর্মীর প্রশিক্ষণ হয়। সুদর্শনের কথায়, ‘‘বাহিনীর সব কর্মী একই ধরনের পরিবেশ থেকে আসেন না। কোনও কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে তাঁর কাজেও সেই প্রভাব পড়তে বাধ্য।’’

মাসখানেক আগে বাহিনীর নিচুতলার কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে আলিপুরের পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে একটি কর্মশালা হয়েছিল। সেখানে অত্যধিক কাজের চাপে তৈরি হওয়া মানসিক অবসন্নতা এবং অবসাদ থেকে পুলিশকর্মীদের মুক্তি পাওয়ার পথ বাতলে দেন উপস্থিত বিশেষজ্ঞেরা। পুলিশকর্মীদের বলা হয়, শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ থাকতে হলে নিয়মিত যোগব্যায়াম ও ধ্যানের পাশাপাশি পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। যদিও সেই কর্মশালায় অংশ নেওয়া বাহিনীর এক কর্মী বললেন, ‘‘বাড়ি থেকে এক বার বেরোলে ফেরার সময়ের ঠিক থাকে না। দিন-রাত থানাতেই কাটিয়ে দিতে হয়। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাব কখন? তাই পুলিশের মনের অসুখ ব্যাপারটাই বিলাসিতার মতো শোনায়।’’ (শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

police Mental Health

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy