Advertisement
E-Paper

শিল্পীর হাত ধরে ‘শিল্প’ এল সিঙ্গুরের কাছেই

এত বছর বাদে সিঙ্গুরের সেই প্রকল্প এলাকার কাছেই ‘শিল্প’ এল। সরকার বা শিল্পোদ্যোগীর হাত ধরে নয়, শিল্পীর রং-তুলিতে!

প্রকাশ পাল 

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৩:২৩
এ সবই উঠে এসেছে প্রদর্শীনতে। ছবি: দীপঙ্কর দে

এ সবই উঠে এসেছে প্রদর্শীনতে। ছবি: দীপঙ্কর দে

বিরোধীদের আন্দোলনের জেরে সিঙ্গুরে শিল্প গড়তে পারেনি টাটাগোষ্ঠী। এত বছর বাদে সিঙ্গুরের সেই প্রকল্প এলাকার কাছেই ‘শিল্প’ এল। সরকার বা শিল্পোদ্যোগীর হাত ধরে নয়, শিল্পীর রং-তুলিতে!

এই শিল্পে কৃষিজমি অধিগ্রহণ নেই। কারখানার ছাউনি নেই। বড় বড় যন্ত্র নেই। এখানে গাছে ঝুলতে থাকা ‘মৌচাক’ যে আসলে ঘুঁটের তৈরি, সামনে থেকে না-দেখলে বোঝা দায়। রং করা ধান গাছের গোড়া পানাপুকুরে যেন শালুক ফুল! বাঁশঝাড়ের পাশে মাটি দিয়ে তৈরি মাতৃজঠরে শিশুর অবয়ব। হুগলির পোলবা-দাদপুর ব্লকের অখ্যাত কোমধাড়া গ্রামটা যেন আস্ত ক্যানভাস!

বারো দিন ধরে কোমধাড়ায় এই শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজক শিল্পীদের আন্তর্জাতিক মঞ্চ ‘ন্যারেটিভ মুভমেন্টস’। মঙ্গলবার ছিল শেষ দিন। দ্বি-বার্ষিক প্রদর্শনী বিশ্বের নানা জায়গায় হয়েছে। এ দেশেও। তা বলে আর্থ-সামাজিক ভাবে তথাকথিত অনুন্নত এই ‘গণ্ডগ্রামে’! যেখানে যোগাযোগের মাধ্যম শুধু টোটো আর ম্যাজিক গাড়ি! উদ্যোক্তাদের দাবি, গ্রামে এমন প্রদর্শনী এই প্রথম। কোমধাড়া বারোয়ারি সমিতির সহযোগিতায় গ্রামের সাড়ে তিন কিলোমিটার চৌহদ্দি এই উপলক্ষে সাজিয়ে তোলা হয়। মাটি, বাঁশ, খড়, কাঠ, ঘুঁটে দিয়ে হরেক শিল্পকর্ম তৈরি হয়। উদ্যোগের মূল হোতা বিবেক সাঁতরা গ্রামেরই ছে‌লে। পেশায় চিত্রশিল্পী মানুষটি এখন ভিন্‌ রাজ্যে থাকেন। নিজের গ্রামে ‘কিছু করা’র ভাবনা থেকেই তিনি উদ্যোগী হন। প্রদর্শন‌ীর কিউরেটর তিনি।

মাটির বাড়ির নিকানো উঠোনে, দেওয়ালে, গাছে, পুকুরে, ধানের মড়াইতে, চালাঘরে নানা কায়দায় ফুটিয়ে তোলা হয় শিল্পকর্ম। এবড়ো-খেবড়ো মাটির দেওয়ালে বা লেপে রাখা ঘুঁটেতে হরেক মুখের সারি। দেওয়ালে ঝুলছে কুলোয় আঁকা ছবি। গাছে আটকে থাকা ‘ঘুড়ি’ গামছা আর ধুতি দিয়ে বানানো। কোনও দেওয়ালে এই সব কাজের মাঝে কচিকাঁচারা সেঁটে দিয়েছে তাদের অপটু হাতের আঁকা। দেওয়ালে আঁকা ডানার মাঝে এসে পালা করে দাঁড়াচ্ছে কিশোরীর দল। ভাবখানা এই, ‘আমিই সেরা পরি’! আর রয়েছে সেই ‘শিল্প’ও। সিঙ্গুরে না-হওয়া ন্যানোর খোল। অনেকটা মানুষের মুখের চেহারায়। সামনে কৃষিজমি। শিল্পী কাঁচরাপাড়ার দিবাকর কর্মকারের দাবি, ‘‘কৃষি এবং শিল্প মানুষের কোনটা বেশি দরকার, এই প্রশ্ন রাখার চেষ্টা করেছি।’’

উদ্যোক্তাদের তরফে পবিত্র মিত্র বলেন, ‘‘প্রদর্শনী দেখতে গ্যালারিতে যেতে হয়। আর এই গ্রামটাই আস্ত প্রদর্শনী।’’ তিনি জানান, গ্রামবাসীরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে এসেছেন। শিল্পীদের সহযোগীর কাজ করেছেন। দেশীয় শিল্পীদের পাশাপাশি মিশর, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটেন, মঙ্গোলিয়া, ইতালি-সহ নানা দেশ থেকে শিল্পীরা এসেছেন। তাঁদের থাকার জন্য পরিত্যক্ত প্রাথমিক স্কুলের ভবন সংস্কার করা হয়। সেই ছাদে চলেছে ছবি আঁকার প্রদর্শনী। ছিল আলোকচিত্র প্রদর্শনীও।

গত ৮ তারিখে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন কবি নমিতা চৌধুরী। হাঙ্গেরিয়ান শিল্পীর প্রদর্শনীর উদ্বোধক সেখানকার কালচারাল সেন্টারের ডিরেক্টর উইলিয়াম জ়োলটন। কর্মশালায় মুখোশ, মাটির জিনিস, খড়ের পুতুল তৈরি করেছে গ্রামের কচিকাঁচারা। বারোয়ারিতলায় ধানের গোলার আদলে সাংস্কৃতিক মঞ্চে হয়েছে ছৌ-নাচ, কবির লড়াই-সহ নানা অনুষ্ঠান।

অন্য চেহারায় গ্রামকে দেখে খুশি সব বাসিন্দাই। জয়ন্ত সাঁতরা, শ্রীকান্ত মাঝিদের কথায়, ‘‘প্রদর্শনীর জন্য আমাদের গ্রামের চেহারা বদলে গিয়েছে!’’ কোমধাড়া বারোয়ারি সমিতির সভাপতি ডাকেশ্বর মালিক বলেন, ‘‘কত লোক গ্রামে প্রদর্শনী দেখতে আসছেন। আবারও এমন প্রদর্শনী হোক।’’

সেই কবে স্কুলবেলায় পাটকাঠি দিয়ে রবি ঠাকুরের মুখ তৈরি করেছিলেন‌ প্রিয়া মালিক। কর্মশিক্ষার ক্লাসে। এখন তিনি কোমধাড়া গ্রামের বধূ। স্কুলবেলার সেই শিল্প ফের গড়েছেন তিনি। এবং তা ঠাঁই পেয়েছে প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনীর এক উদ্যোক্তাকে দেখে প্রিয়ার শাশুড়ি সন্ধ্যা শুধোন, ‘‘হ্যাঁ গো, বৌমার কাজটা ভাল হয়েছে তো!’’ প্রশংসা শুনে হাসি ধরে না তাঁর।

রাস্তার ধারে, পুকুরপাড়ের গাছে, মাটির দেওয়ালে এখনও বেশ কিছুদিন জ্বলজ্বল করবে এই শিল্পকর্ম।

Singur Industry Trade
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy