Advertisement
E-Paper

তৃণমূলকর্মীর তকমা দিতেই তীব্র প্রতিবাদ

গত পাঁচ দিন কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিলেন তিনি। নিজেদের যথাসর্বস্ব দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চালাচ্ছিল দরিদ্র পরিবার। তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি শাসক দলের কোনও বড় মাপের নেতা। এমনকী, ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করে যাদের হাতে মার খেয়ে তাঁর এই দশা, সেই দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারে পুলিশি ব্যর্থতা নিয়েও মুখ খোলেননি কেউ। কিন্তু সোমবার সকাল থেকেই বদলে গেল দৃশ্যটা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৪৪
ফের নতুন পোস্টার লাগায় তৃণমূল, তবে তাতে উল্লেখ নেই অরূপের দলীয় পরিচয়।

ফের নতুন পোস্টার লাগায় তৃণমূল, তবে তাতে উল্লেখ নেই অরূপের দলীয় পরিচয়।

গত পাঁচ দিন কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিলেন তিনি। নিজেদের যথাসর্বস্ব দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চালাচ্ছিল দরিদ্র পরিবার। তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি শাসক দলের কোনও বড় মাপের নেতা। এমনকী, ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করে যাদের হাতে মার খেয়ে তাঁর এই দশা, সেই দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারে পুলিশি ব্যর্থতা নিয়েও মুখ খোলেননি কেউ। কিন্তু সোমবার সকাল থেকেই বদলে গেল দৃশ্যটা।

এ দিন ভোর সাড়ে ছ’টায় মারা যান হাওড়ার বিবিবাগান এলাকার হৃষিকেশ ঘোষ লেনের বাসিন্দা অরূপ ভাণ্ডারী। এলাকায় সেই খবর এসে পৌঁছতেই আসরে হাজির স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা। অরূপের বাড়ির সামনে মুহূর্তের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল ক্যাম্প। একে একে এসে পৌঁছলেন দলের ছোট-বড়-মাঝারি নেতারা। ধীরে ধীরে গোটা এলাকা চলে গেল শাসক দলের দখলে। এর আগে একাধিক মৃত্যুর ঘটনায় ঠিক যে ছবি দেখেছেন এ রাজ্যের মানুষ।

অরূপ তৃণমূল কর্মী ছিলেন, এমন কথা শোনা যায়নি এত দিন। কিন্তু তাঁকে দলীয় কর্মী আখ্যা দিয়ে ঝোলানো হল ফেস্টুন। দাবি, অপরাধীদের গ্রেফতার করতে হবে। এই বার প্রতিবাদ করলেন অরূপের পরিজন এবং পড়শিরা। বললেন, মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। সেই প্রতিবাদের মুখে অরূপের ‘তৃণমূল কর্মী’ তকমা ঘুচল বটে, কিন্তু এলাকা ‘দখলমুক্ত’ হল না। উল্টে জেলার নানা জায়গা থেকে আনা হলো আরও তৃণমূল কর্মী। রাতে সালকিয়ার বাঁধাঘাটে অরূপের শেষকৃত্য না-হওয়া পর্যন্ত জমি ছাড়লেন না তাঁরা।

ভাণ্ডারী পরিবারে অরূপের মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছনোর পরে সকাল সাতটা থেকেই আনাগোনা শুরু হয় তৃণমূল কর্মীদের। বাড়ির সামনে চেয়ার-টেবিল পেতে বসে যায় ক্যাম্প অফিস। ৯টা নাগাদ সেখানে আসেন উত্তর হাওড়ার তৃণমূল সভাপতি তথা হাওড়া পুরসভার মেয়র পারিষদ গৌতম চৌধুরী। আধ ঘণ্টা পরে তিনি সদলবল ঢোকেন অরূপের বাড়িতে। কিছু ক্ষণ পরে বেরিয়ে এসে বলেন, “এটা কোনও রাজনৈতিক ব্যাপার নয়। খবর পাওয়ার পরেই আমরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব আমরা নিয়েছি।”

সকাল ১০টা নাগাদ হাজির হন হাওড়া পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তৃণমূলের মনজিৎ র্যাফেল ও তাঁর স্বামী সুভাষ র্যাফেল। গত ২৮ জানুয়ারি রাতে অরূপ মার খাওয়ার পরেই অভিযোগ উঠেছিল, আক্রমণকারীরা এঁদের ঘনিষ্ঠ। এমনকী, সুভাষ টাকা নিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে বলেছিলেন বলেও অভিযোগ করেছিলেন অরূপের বাবা। এই সব অভিযোগই অবশ্য অস্বীকার করেছেন সুভাষরা।

বেলা সাড়ে দশটার সময় প্রায় একশো তৃণমূল কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে অরূপের বাড়িতে ঢোকেন সুভাষ ও মনজিৎ। সেখান থেকে বেরিয়ে মনজিৎ দাবি করেন, অরূপকে দেখতে প্রতিদিনই হাসপাতালে গিয়েছিলেন তিনি। যে দাবি উড়িয়ে অরূপের পরিবার জানাচ্ছে, মনজিৎ মাত্র এক দিন গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

স্থানীয় কর্মীরা এলাকায় দখলদারি পোক্ত করার পরে আনাগোনা শুরু হয় জেলার শীর্ষ তৃণমূল নেতাদের। বেলা একটা নাগাদ আসেন দলের জেলা সভাপতি (শহর) তথা রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ রায়। তার পর মেয়র রথীন চক্রবর্তী। বিকেলে অরূপের দেহ আসার কিছু আগে হাজির হন স্থানীয় বিধায়ক তৃণমূলের অশোক ঘোষ।

মন্ত্রী অরূপ চলে যাওয়ার পরেই শুরু হয় নতুন নাটক। ভাণ্ডারীদের বাড়িতে ঢোকার রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে পড়েন কয়েক জন মহিলা। তৃণমূল কর্মী বাদে সকলের, এমনকী সাংবাদিকদের প্রবেশও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। চারপাশে শুরু হয় পোস্টার লাগানো, ফেস্টুন ঝোলানো। সেখানে অরূপ ‘তৃণমূল কর্মী’। ঠিক যে ভাবে দত্তপুকুরে প্রতিবাদী যুবক সৌরভ চৌধুরীর মৃত্যুর পরে তাঁর গায়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কর্মী বলে তকমা ঝোলানোর চেষ্টা হয়েছিল।

এই সময়ই সরব হয় ভাণ্ডারী পরিবার। অরূপের মামাতো ভাই তুতুন সাঁতরা পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে দেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলতে থাকেন, “ও (অরূপ) কবে তৃণমূল কর্মী হলো? যা ইচ্ছা তাই হচ্ছে!” কেউ কেউ তাঁকে থামাতে এলে তুতুন বলেন, “ভয় পাব কেন? লাশ ফেলে দেবে নাকি?”

তুতুনের প্রতিবাদে সামিল হন এলাকার বাসিন্দারাও। বুকে কালো ব্যাজ লাগান তাঁরা। প্রকাশ্যেই বলেন, “তৃণমূল এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে।” এহেন পরিস্থিতিতে মনজিৎ জনতার সামনেই কবুল করে ফেলেন, “অরূপ কোনও দিনও তৃণমূল করত না। ওর সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক নেই।” ফেস্টুন ভাঁজ করে চাপা দিয়ে দেওয়া হয় তৃণমূল কর্মী কথাটি। যদিও এ সবের পরেও অরূপ রায়ের দাবি, “প্রতিবেশীরা যা-ই বলুক, অরূপ তৃণমূল করতেন। ওর সঙ্গে যাঁরা দল করতেন, তাঁরাই ওই পোস্টার লাগিয়েছেন। পরে তা খুলেও নেওয়া হয়েছে।”

স্থানীয় মানুষের চাপে অরূপের ‘তৃণমূল কর্মী’ তকমা মুছলেও এলাকার দখল কিন্তু ছাড়েনি শাসক দল। উল্টে তা আরও পোক্ত করা হয়। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এসে পৌঁছলে তাঁকে অরূপদের বাড়িতে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। কংগ্রেসের অভিযোগ, সেই দলে কয়েক জন মহিলা ছাড়া পুলিশ কর্মীরাও ছিলেন। কুড়ি মিনিট ধাক্কাধাক্কির পরে কোনওমতে অরূপের বাড়ির ভিতরে ঢোকেন অধীর। পরে তিনি বলেন, “অরূপের মা বলেছেন, তাঁদের টাকার লোভ দেখানো হচ্ছে।” শুনে তৃণমূল কর্মীরা আওয়াজ তোলেন, “গো ব্যাক অধীর চৌধুরী।”

সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ মেডিক্যাল কলেজের পুলিশ মর্গ থেকে বের করা হয় অরূপের মৃতদেহ। পুলিশ পাহারায় সাতটার সময় তা গিয়ে পৌঁছয় বিবিবাগানের বাড়িতে। এলাকায় তখন থিকথিক করছেন তৃণমূল কর্মীরা। মিনিট পনেরো পরে মৌন মিছিল রওনা দেয় বাঁধাঘাটের পথে। তৃণমূলের নজরদারিতেই। শেষকৃত্য সম্পন্ন না-হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকে সেই নজরদারি।

দেহ দখলের এই রাজনীতির সমালোচনায় সরব হয়েছেন বিরোধীরা। এর আগে মধ্যমগ্রামের গণধর্ষণ কাণ্ডে নির্যাতিতা যখন এয়ারপোর্টের ভাড়া বাড়িতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান, তখনও মৃতদেহ দখল করতে তৃণমূল ও পুলিশের অতি তৎপরতা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন রাজ্যবাসী। শাসক দল চেয়েছিল, দেহ দখল করে রাতের অন্ধকারেই শেষকৃত্য সেরে ফেলতে। পরিবারের আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত অবশ্য তা সফল হয়নি। অভিযোগ, পুলিশের সামনেই নির্যাতিতার বাবা-মাকে মামলা তুলে নিয়ে রাজ্য ছেড়ে বিহারে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দিয়েছিলেন এলাকার তৃণমূল নেতারা। তা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল বিস্তর। কিন্তু তৃণমূলের মনোভাবে কোনও বদল হয়নি।

বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, “দুষ্কৃতীদের হাতে ওই যুবক আক্রান্ত হওয়ার সময় শাসক দল নেই। ঘটনার পরে পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শাসক দলের কোনও ভূমিকা নেই। বরং, তৃণমূলের এক কাউন্সিলর ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এখন মরদেহ হাইজ্যাক করতে নেমে পড়েছে শাসক দল।” তবে স্থানীয় মানুষ যে ভাবে তৃণমূলের ফ্লেক্স-ফেস্টুন খুলে দিয়েছেন, তাকে ইঙ্গিতপূর্ণ বলেই মনে করছেন সূর্যবাবু।

দুষ্কৃতীদের অবিলম্বে গ্রেফতার, নিষ্ক্রিয় পুলিশের শাস্তি এবং ঘটনা আড়াল করতে উদ্যোগী তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এই তিন দাবিতে আজ, মঙ্গলবার হাওড়া পুলিশ কমিশনারের দফতরের সামনে বিক্ষোভ-অবস্থানের ডাক দিয়েছে বামফ্রন্ট। কাল, বুধবার হাওড়া জেলায় ১২ ঘণ্টা বন্ধেরও ডাক দিয়েছে তারা। সে দিনই আবার হাওড়ায় ২৪ ঘণ্টার বন্ধ ডেকেছে কংগ্রেস।

হাওড়ার ঘটনার নিন্দা করে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহের অভিযোগ, “রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। এখানে গুন্ডারাজ চলছে। তার রানি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।” বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যও বলেছেন, “পুলিশ-নেতা-মন্ত্রী সব মিলেমিশে একাকার। পুলিশের ব্যর্থতা ঢাকতে মন্ত্রীরাও রাস্তায় নামছেন।”

সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে নাজেহাল তৃণমূলের ফাটল আরও চওড়া করেছে হাওড়ার ঘটনা। এ দিন কার্যত বিরোধীদের সুরে সুর মিলিয়ে মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত বলেছেন, “পুলিশের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল।” কিন্তু পুলিশমন্ত্রী তো খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! সব্যসাচীর জবাব, “একা এক জনের পক্ষে তো সব কিছু করা সম্ভব নয়।” এই মন্তব্যের পিছনেও মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি প্রচ্ছন্ন খোঁচাই দেখছেন তৃণমূলের অনেকে। তাঁদের মতে, শিলান্যাস থেকে সংগঠন মমতা একাই যে ভাবে সব কাজ করেন, তা নিয়ে দলে যথেষ্ট অসন্তোষ রয়েছে। সব্যসাচী সুকৌশলে সেই অসন্তোষই উস্কে দিয়েছেন।

তৃণমূলের অন্য নেতারা অবশ্য এ দিন মুক্তকণ্ঠে পুলিশের প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, পুলিশের ভূমিকায় তাঁরা খুশি। কেন? জবাব মেলেনি। এক নেতা শুধু একান্তে বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীই পুলিশমন্ত্রী। খুশি না হয়ে উপায় কী!”

—নিজস্ব চিত্র

arup bhandari murder salkia hrishikesh sen lane bibibagan tmc arup roy protest against eve teasing
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy