Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ভাষা আন্দোলনের আখ্যান বর্ধমানের ভূমিপুত্রের হাতে

ওপার বাংলার ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হতে আমাদের কোনও বাধা নেই যখন দেখি, ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রামাণ্য আখ্যান রচনা করেন বর্ধমানেরই এক ভূমিপুত্র, বদরুদ্দিন উমর।

ভাষা-শহিদ স্মারক। (ইনসেটে) বদরুদ্দিন উমর। নিজস্ব চিত্র

ভাষা-শহিদ স্মারক। (ইনসেটে) বদরুদ্দিন উমর। নিজস্ব চিত্র

ত্রিদিবসন্তপা কুণ্ডু
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:৩৯
Share: Save:

একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি দুই বাংলার মানুষের কাছেই ভীষণ প্রাসঙ্গিক, ছয় দশক পরেও। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই পৃথিবীর মানচিত্রে ১৯৭১ সালে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতার প্রাক্কালে শরৎচন্দ্র বসু, সুরাবর্দী, আবুল হাসিমরা যে স্বাধীন বাংলার রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন তা যে অলীক কল্পনা ছিল না, বাংলাদেশের জন্ম আমাদের সেই কথা মনে করিয়ে দেয়।

ওপার বাংলার ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হতে আমাদের কোনও বাধা নেই যখন দেখি, ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রামাণ্য আখ্যান রচনা করেন বর্ধমানেরই এক ভূমিপুত্র, বদরুদ্দিন উমর। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত তাঁর তিন খণ্ডে রচিত অসংখ্য সাক্ষাৎকার ও দলিল সংবলিত ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (১৯৭০) গ্রন্থটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসচর্চায় একটি অপরিহার্য গ্রন্থ। বিগত শতাব্দীর এক অগ্রগণ্য ইতিহাস-চিন্তাবিদ ইতিহাসের ছাত্রদের উপদেশ দিয়েছিলেন ইতিহাসকে বুঝতে হলে ইতিহাসবিদকে জানা প্রয়োজন এবং সে জন্য জরুরি তাঁর সময়কে জানা। তাই এই আখ্যানকার কোন পরিবেশে বড় হয়েছিলেন তা জানা দরকার।

বর্ধমানের একটি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত, রাজনীতিমনস্ক পরিবারে বদরুদ্দিন উমরের (১৯৩১) জন্ম। পিতা আবুল হাসিম ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লিগের প্রথম সারির নেতা। অসাম্প্রদায়িক, চিন্তাশীল, ইসলামীয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষটি মুসলিম লিগে কিছুটা একলা হয়ে পড়েছিলেন শেষের দিকে। বাংলা ভাগ হোক, এটা তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি।

বস্তুত, অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার ধারণাটি ছিল আবুল হাসিমের মস্তিষ্কপ্রসূত। তাঁর নিকট আত্মীয়দের অনেকেই কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ রকম একটি রাজনৈতিক পরিবেশে বদরুদ্দিন উমরের বড় হয়ে ওঠা। পড়াশোনা বর্ধমান টাউন স্কুলে এবং পরে বর্ধমান রাজ কলেজে। দেশভাগের পরে বাংলার মুসলিম লিগ নেতৃত্বের একটি বড় অংশ পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেলেও আবুল হাসিম সেই পথে পা বাড়াননি। তবে ১৯৫০ সালে তাঁদের বর্ধমানের বাড়িতে এক দল দুষ্কৃতী আগুন লাগায়। এই ঘটনায় আবুল হাসিম ভেঙে পড়েন এবং দেশ ছাড়ার দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।

বদরুদ্দিনের বয়স তখন আঠারো। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন দর্শন নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তখন ভাষা আন্দোলনে উত্তাল। তবে সেই আন্দোলনে তিনি যুক্ত হননি। ১৯৫৭ সালে তিনি রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৫৯-৬১ সালে তিনি অক্সফোর্ডে পড়তে যান, যা ছিল তখন মার্কসীয় ইতিহাস চর্চার অন্যতম কেন্দ্র। ইতিহাসের ছাত্র না হলেও তিনি যে ঐ জ্ঞানচর্চার পরিমণ্ডলে প্রভাবিত হয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নাই। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় পূর্ব বঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সারির নেতা নেপাল নাগের, যাঁর উদ্যোগে তিনি দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। ষাটের দশকে তাঁর ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৮) ও ‘সংস্কৃতির সঙ্কট’ (১৯৬৮) নামে দু’টি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়, যার ফলে তিনি রাজরোষের শিকার হন। এর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে বামপন্থী রাজনীতিতে যোগ দেন।

ষাটের দশকের শুরু থেকেই বদরুদ্দিন ভাষা আন্দোলনের একটি তথ্যনির্ভর ইতিহাস লেখার ভাবনা শুরু করেন। ওই আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে যোগ না দেওয়ায় তিনি অনেকটা নির্মোহ অবস্থান নিতে পেরেছিলেন আন্দোলনের ইতিহাস রচনাকালে। ভাষা আন্দোলনকে তিনি নিছক একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসাবে দেখতে রাজি ছিলেন না।

১৯৪৭ পরবর্তী পূর্ব বাংলার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোটিকে বোঝার জন্য বদরুদ্দিন বহু মানুষের সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করেন। সে সব সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ পরে ঢাকা বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে দু’খণ্ডে প্রকাশিত হয় ‘ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ: কতিপয় দলিল’ (১৯৮৪, ১৯৮৫) নামে।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি শুরু থেকেই ছিল এবং এখনও আছে। বিভ্রান্তি রয়েছে আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তি নিয়েও। সচরাচর এই আন্দোলনকে শহুরে, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের আন্দোলন হিসাবেই দেখা হয়ে থাকে। জনতার ভূমিকা সেখানে নাটকের মৃত সৈনিকের মতো। সম্প্রতি বাংলাদেশের কিছু ইতিহাসবিদ এই প্রশ্নটি নতুন করে তুলেছেন। কেন অগণিত সাধারণ মানুষ যাদের অনেকে স্কুলের চৌহদ্দিতে পা রাখেনি এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল?

এই বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসার দিকনির্দেশ বদরুদ্দিন ১৯৭০ সালেই তাঁর লেখায় দিয়েছেন। তিনি ভাষা আন্দোলনকে একটি বিচ্ছিন্ন আন্দোলন হিসাবে দেখেননি। তাঁর বিশ্লেষণে ভাষা আন্দোলন ছিল পূর্ব বাংলার ক্রমবর্ধমান সামাজিক সংঘাতেরই বহিঃপ্রকাশ। তিনি দেখিয়েছেন যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলি ১৯৫২ সালের ভাষা-বিতর্কের সঙ্গে মিলে যায়। যার পরিণতিতেই ভাষা আন্দোলন একটি গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। এই মিলন ঠিক কী ভাবে ঘটেছিল, তা নিয়ে নতুন করে চর্চা করার অবকাশ আছে। বদরুদ্দিন যেখানে শেষ করেছেন, সেখান থেকেই ভাষা আন্দোলন নিয়ে নতুন ধরনের চর্চা শুরু হতে পারে।

পূর্ব পাকিস্তান সরকারের খাদ্য নীতি, কৃষিপণ্যের মূল্য, আমলা ও পুলিসের আচার-আচরণ নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ছিল উর্ধ্বমুখী। ১৯৫২ সালের ভাষা বিতর্ককে কেন্দ্র করে এই ক্রমবর্ধমান অসন্তোষেরই বিষ্ফোরণ ঘটে। এই অসন্তোষের অভিমুখকে সরকার বিরোধী আন্দোলনের দিকে পরিচালিত করায় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের ভূমিকাও ছিল অনস্বীকার্য। যদিও ভাষা আন্দোলনের সরকারি ইতিহাসে এঁদের ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যাবে না।

তাই ভাষা দিবস উদ্‌যাপনের দিনে ভাষা আন্দোলনের এই আখ্যানকারকেও স্মরণ করা প্রয়োজন, যাঁর শিকড় ছিল বর্ধমানের মাটিতে গাঁথা। সেই শিকড়ের টানেই তিনি নিয়মিত বর্ধমানে আসেন। কিছু কাল আগে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বর্ধমানের কথা উঠতেই তিনি বলে ওঠেন, ‘‘বর্ধমানে এলে এক ধরনের ঘরে ফেরার অনুভূতি হয়।’’ আঠারো বছর বয়েসে ছেড়ে যাওয়া বর্ধমান শহরকে ভুলতে পারেননি বদরুদ্দিন। মনে-প্রাণে এখনও তিনি বর্ধমানের মানুষ থেকে গিয়েছেন।

লেখক আসানসোলের বিবি কলেজের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Badruddin Umar language movement narrative
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE