Advertisement
২৬ মে ২০২৪

পুত্রহত্যার বিচার চেয়ে ৮ বছর পরে চিঠি মায়ের

মায়ের অভিযোগ, তাঁর নিরপরাধ, স্কুলশিক্ষক ছেলে সৌম্যজিৎকে পুলিশ নিজেদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল।

সৌম্যজিৎ বসু এবং মা সুমিতাদেবী।

সৌম্যজিৎ বসু এবং মা সুমিতাদেবী।

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৯ ০২:০৮
Share: Save:

বুকের মধ্যে পুত্রশোকের যন্ত্রণা চেপে লোকচক্ষুর আড়ালে আট বছর ধরে নীরবে কেঁদেছেন তিনি। ৭৪ বছরের সেই মা এ বার মুখ খুললেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়ে বিচার চাইলেন অযোধ্যা পাহাড়ে মাওবাদীদের হাতে নিহত সৌম্যজিৎ বসু (৩৩)-র মা সুমিতাদেবী।

মায়ের অভিযোগ, তাঁর নিরপরাধ, স্কুলশিক্ষক ছেলে সৌম্যজিৎকে পুলিশ নিজেদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। প্রতি মুহূর্তে সৌম্যের পরিবারকে ভুল পথে চালিত করেছেন পুলিশকর্তারা। সৌম্যজিৎদের অপহরণের পরে তাঁদের বাড়িতে এসে মাওবাদী বেশ কিছু নেতানেত্রী কয়েক দফায় থেকে গিয়েছেন এবং সেই তথ্য পুলিশের জানা ছিল। এমনকি তাঁদের কাছ থেকে কয়েক দফায় টাকাও নিয়ে গিয়েছিলেন মাওবাদী নেতানেত্রীরা। তাঁরা আশ্বাস দিতেন, সৌম্যেরা বেঁচে আছেন। ফিরে আসবেন।

সুমিতাদেবীর অভিযোগ, সৌম্যকে খুনের ঘটনায় অন্যতম মূল অভিযুক্ত বলে সিআইডি যাঁকে গ্রেফতার করেছিল, আজ তাঁকে ‘হিরো’র মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সেই অভিযুক্ত অর্ণব দাম ওরফে ‘বিক্রম’ সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলায় জামিন পেয়েছেন। সংবাদপত্রে অর্ণবকে মেধাবী বলা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে মায়ের প্রশ্ন, ‘‘হতে পারে, অর্ণবের বাবা-মা তাঁদের ছেলেকে নিয়ে গর্বিত। কিন্তু আমার ছেলেকে খুনের বিচারের কী হবে?’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

অভিযোগ, সৌম্যজিৎদের সেই মামলায় এখনও চার্জশিট দিতে পারেনি পুলিশ। অন্যতম অভিযুক্ত রঞ্জিত পাল আত্মসমর্পণ করেছেন। পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তাঁকে রাখা হচ্ছে বিভিন্ন পুলিশ শিবিরে। মুখ্যমন্ত্রীকে সুমিতাদেবীর প্রশ্ন, ‘‘কোনও বিচার ছাড়াই ছেলের হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ পাবে, এটা জানতে পেরে পুত্রহারা মায়ের মনের কী অবস্থা হতে পারে, আন্দাজ করতে পারেন?’’

২০১০ সালের অক্টোবরে পুলিশ ইনস্পেক্টর বন্ধু পার্থ বিশ্বাসের সঙ্গে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় বেড়াতে যান ব্যান্ডেলবাসী পরিবেশপ্রেমী সৌম্যজিৎ। বাড়িতে স্ত্রী, ছেলে, দুই দাদা-বৌদি, তাঁদের ছেলেমেয়েরা— ভরা সংসার। ২২ অক্টোবর রাতে ফোন আসে সৌম্যের মোবাইল থেকে। অচেনা কণ্ঠ, কথা বলতে চান সুমিতাদেবীর সঙ্গে। নিজেদের মাওবাদী পরিচয় দিয়ে সৌম্যের সবিস্তার পরিচয় জানতে চান তাঁর মায়ের কাছেই। সৌম্য যে পুলিশ অফিসার নন, তা জানার পরে অচেনা কণ্ঠ ফোনে বৃদ্ধাকে বলেন, ‘চিন্তা করবেন না। সৌম্যকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’ সৌম্যও ফোনে মাকে বলেন, ‘‘আমাদের ছেড়ে দেবে বলেছে।’’

সেই শেষ। আর ফোন আসেনি সৌম্যের। মোবাইলে যোগাযোগ করা যায়নি। সুমিতাদেবীর অভিযোগ, ‘‘জানতে পেরেছি, সেই ২২ অক্টোবর রাতেই মেরে ফেলা হয় ওদের। অথচ তার পরে কয়েক মাস পুলিশের বড় কর্তারা ক্রমাগত আমাদের ভুল বুঝিয়ে বলে গিয়েছেন, সৌম্যেরা বেঁচে আছে। মাওবাদীদের হেফাজতে রয়েছে। ওদের ফিরিয়ে আনা হবে।’’ সৌম্যের দাদা অভিজিৎ বলেন, ‘‘আমাদের বলা হয়েছিল, আমরা যেন অর্ণবের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু বহু বার চেষ্টা করেও অর্ণবের বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। ওঁরা দেখা করেননি।’’

ঘটনার ছ’মাস পরে অযোধ্যা পাহাড়ের কোল থেকে উদ্ধার হয় দু’টি দেহ। তত দিনে সেগুলো শুধু কঙ্কাল।

পুলিশের অনুরোধ মেনে সৌম্যের ছেলে রোদ্দুর ও সুমিতাদেবীর দেহরসের নমুনা নিয়ে ডিএনএ মিলিয়ে দেখা যায়, একটি দেহ সৌম্যের। তার পর থেকেই চুপ করে যান সুমিতাদেবী। কিন্তু ১২ এপ্রিল সংবাদপত্রে অর্ণবের জামিন পাওয়ার খবর শুনে সে-দিনই বড় ছেলে অভিজিৎকে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ই-মেল পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

পুরুলিয়ার বলরামপুর থানায় ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি নিখোঁজ মামলা হয়। সৌম্যদের দেহ উদ্ধারের পরে সিআইডি-র হাতে তুলে দেওয়া হয়। সিআইডি-র খবর, সৌম্য-পার্থকে হত্যার অভিযোগেই অর্ণবকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

পুলিশি সূত্রের খবর, পরে বিনপুরের শিলদা থানায় ইএফআর জওয়ানদের গুলি করে হত্যার মামলাও যোগ হয় অর্ণবের নামে। সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে সেই মামলায় জামিন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু কলকাতা পুলিশের একটি মামলা এখনও ঝুলছে অর্ণবের নামে। সেই মামলায় তাঁর জামিন হয়নি। তিনি এখন রয়েছেন হুগলি জেলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Crime
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE