Advertisement
২০ মে ২০২৪

জেনেও কেন নিষিদ্ধ ওষুধ বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায়

বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় পাঁচ বছর আগে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও কলকাতার বেশ কিছু চিকিৎসক গোপনে সেই ওষুধ রোগীকে দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

ওষুধের নাম না দিয়ে প্রেসক্রিপশনে তার আদ্যক্ষর লিখে দায় এড়িয়েছেন চিকিৎসক।

ওষুধের নাম না দিয়ে প্রেসক্রিপশনে তার আদ্যক্ষর লিখে দায় এড়িয়েছেন চিকিৎসক।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৬ ০৪:০৯
Share: Save:

বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় পাঁচ বছর আগে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও কলকাতার বেশ কিছু চিকিৎসক গোপনে সেই ওষুধ রোগীকে দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক ১৬ সদস্যের এক অনুসন্ধান কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে গোটা দেশে বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় ওই ওষুধের ব্যবহারে আপত্তি জানিয়েছে। কমিটির রিপোর্টে ছিল, ওই ওষুধে ডিম্বাশয়ে ক্যানসার হওয়ার পাশাপাশি গর্ভস্থ শিশুর বিকলাঙ্গ হওয়া বা তার জিনগত বৈকল্য হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই রিপোর্ট জানার পরেও কয়েক জন বন্ধ্যত্ব বিশেষজ্ঞ চোরাগোপ্তা সেই ওষুধই বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় প্রয়োগ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

গত সপ্তাহেই রাজ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তার দফতরে এ ব্যাপারে একটি অভিযোগ দায়ের করে বেহালার বাসিন্দা বছর ২৯-এর মনামি রায় (নাম পরিবর্তিত) জানিয়েছেন, কলকাতার এক স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ তাঁর বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় টানা তিন মাস ওই ওষুধ ‘লেট্রোজল’ (জেনেরিক নাম) দিয়েছেন। না জেনেই ওই মহিলা ওষুধ খেয়েছেন। তার পর অন্য এক চিকিৎসক বিষয়টি জেনে তাঁকে সতর্ক করেন। মনামিদেবীর কথায়, ‘‘রোগীর পক্ষে সব সময় জানা সম্ভব নয় কোন ওষুধ কোন কোন ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ। আমরা চিকিৎসকের উপরেই ভরসা করি। তিনি যদি বিশ্বাসের সুযোগ নেন তা হলে তো আমরা অসহায়।’’

স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন বেঙ্গল অবস্ট্রেটিক অ্যান্ড গাইনকোলজিক্যাল সোসাইটির সচিব অবিনাশ রায়ের কথায়, ‘‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যা-ই হোক না কেন, বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় লেট্রোজলের সাফল্যের হার খুব ভাল। ফলে অনেক ডাক্তার এখনও এটা ব্যবহারের লোভ ছাড়তে পারেন না। গোপনে রোগীদের খাওয়ান।’’ স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এতে অনেক চিকিৎসকের দ্রুত পসার বাড়ে। ফলে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে গর্ভস্থ ভ্রূণের কী পরিণতি হবে, তা নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাতে নারাজ।’’

তবে চিকিৎসকেরা এ কথাও জানিয়েছেন, লেট্রোজল পছন্দ করেন এমন চিকিৎসকদের গোষ্ঠী যথেষ্ট শক্তিশালী। বন্ধ্যত্ব-চিকিৎসায় তাঁরা এই ওষুধের ব্যবহার ফিরিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তাতে অনেক বিতর্কও রয়েছে। অন্যতম প্রবীণ বন্ধ্যত্ব বিশেষজ্ঞ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী লেট্রোজলের পক্ষে সওয়াল করেছেন। নিজের ক্লিনিকে প্রায় সাড়ে ছ’শো মহিলার উপর লেট্রোজলের প্রভাব নিয়ে তিনি একটি সমীক্ষা করেন ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত। সেই রিপোর্ট তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রকে জমাও দেন ২০১৪ সালে। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা প্রমাণ পেয়েছিলাম, লেট্রোজল ব্যবহারের জন্য আলাদা করে মা বা শিশুর ক্ষতি হয় না। তা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য মন্ত্রক একে বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় ব্যবহার করতে দিচ্ছে না।’’ আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘আমাদের ১৬ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটিতে যথেষ্ট অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা আছেন। তাঁদের মতামতের কি মূল্য নেই?’’

এই বিতর্কের মধ্যেই নানা উপায়ে লেট্রোজলের ব্যবহার চলছে বলে অভিযোগ। যেমন বেহালার মনামি রায়ের ক্ষেত্রে এক চিকিৎসক তাঁর প্রেসক্রিপশনে একাধিকবার ওষুধের জায়গায় ইংরেজির ‘L’ অক্ষর লিখে সেটা কতটা, কত বার খাওয়া উচিত তা লিখেছেন। মনামি বলেন, ‘‘ডাক্তারবাবু ‘L’ লিখেছেন প্রেসক্রিপশনে। আর আলাদা একটা চিরকুটে ‘লেট্রোজল’ কথাটা লিখে হাতে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, দোকানে ওষুধ কিনতে গেলে এই চিরকুট দেখালেই হবে। সেই ভাবেই তিন মাস ওষুধ কিনেছি।’’

ওই রোগিণীর নাম করেই বৃহস্পতিবার ২৪ জুলাই দুপুরে ফোন করা হয়েছিল সেই চিকিৎসককে। ফোন ধরেন তাঁর মহিলা সহকারী। তাঁকেই জানানো হয়, চিরকুট হারিয়ে গিয়েছে। ওষুধের নামও মনে পড়ছে না। দয়া করে তিনি যেন ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করে ‘L’ অক্ষরের ওষুধটির পুরো নামটা বলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওই মহিলা টেলিফোনে বলেন, ‘‘লিখে নিন, ওটা ‘লেট্রোজ (লেট্রোজল গ্রুপের ওষুধের ব্র্যান্ড নেম) ২.৫ এমজি। ওটা সব জায়গায় পাবেন না। আমাদের ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের ক্লিনিকের দোকানে পেয়ে যাবেন।’’ এর পরের ফোনটি সরাসরি ওই চিকিৎসকের ব্যক্তিগত মোবাইলে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে করা হয়। তখন তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে প্রেসক্রিপশন দেখতে চান। ওই ক্লিনিকে গিয়ে তাঁকে প্রেসক্রিপশনও দেখানো হয়।

ওই স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ বাণীকুমার মিত্রের মন্তব্য, ‘‘L’ আমি লিখিনি। অন্য কেউ লিখে দিয়েছে।’’ বার-বার তাঁর প্রেসক্রিপশনে অন্য কেউ কেন ‘L’ লিখবেন? এ বার তিনি বলেন, ‘‘ওটা তো ‘L’ নয়, ইংরেজিতে অন্য কিছু লেখা।’’ তার পর একটু থেমে তিনি হঠাৎ বলে বসেন, ‘‘তবে লেট্রোজল খুব ভাল ওষুধ।’’

তবে এই ওযুধটি আসলে স্তন ক্যানসারের ওষুধ। বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও ক্যানসারের চিকিৎসায় এটি ব্যবহার হয়। ফলে বিক্রিও হয়। ড্রাগ কন্ট্রোলের কর্তারা বলেন, ‘‘কোন দোকান কাকে ক্যানসারের জন্য আর কাকে বন্ধ্যত্বের জন্য এটা বিক্রি করল, সেটা সব সময় দেখা অসম্ভব। একমাত্র চিকিৎসকদের শুভবুদ্ধিই একে রুখতে পারে।’’ তবে কলকাতার অনেক জায়গায় বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার নামে যাচ্ছেতাই কাণ্ড চলছে বলে মেনে নিয়েছেন নামী ও প্রবীণ বন্ধ্যত্ব বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। সে দিকে নজরদারি নেই বলেই বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় লুকিয়ে নিষিদ্ধ ওষুধের প্রয়োগ বাড়ছে।

দেশের ইনফার্টিলিটি সেন্টারগুলিকে আইনের আওতায় আনতে ‘অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকটিভ টেকনোলজি (রেগুলেশন) বিল’ (এআরটি বিল) এর খসড়া তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০০৫-০৬ সালে। কিন্তু এখনও এই সেন্টারগুলিতে নজরদারির জন্য আইন হয়নি। ন্যাশনাল এআরটি রেজিস্ট্রি-তেও মাত্র ৩০ শতাংশ ইনফার্টিলিটি ক্লিনিকের নাম নথিভুক্ত। বাদ বাকি অসংখ্য ক্লিনিকে কী চলছে কেউ জানে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

medicine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE