রবি-নমি: বর্ধমানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রয়েছেন মহারাজ বিজয়চন্দও। ছবি সৌজন্য: ‘আলোকচিত্রে বর্ধমানের ঐতিহ্য’ (অশোক দাশগুপ্ত)
বর্ধমান জেলা ভাগ হবে— পুবে, পশ্চিমে। তাতে প্রশাসনিক সুবিধা হবে, উন্নয়নও ঘটবে, এমন কথা শোনা যাচ্ছে। ফলে পুরনো বর্ধমানের নানা ইতিহাসের কথা মনে পড়ে যাবে। আধুনিকতম হওয়ার আগে আধুনিকতার অবস্থাটা পর্যালোচনা করাও যেতে পারে এই সুযোগে।
কাটোয়া-কালনা-মেমারি-খোদ বর্ধমান-রায়না ইত্যাদি নিয়ে যে পুবমুখী বর্ধমান, তার প্রাচীনত্ব নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় ১৯৬২-৬৫ সালের মধ্যে পাণ্ডুরাজার ঢিবি খননের সময়। চতুর্থ শতকের বইপত্রে মল্লসারুল তাম্রপট্টে ‘বর্ধমান ভুক্তি’র কথা পেয়েছি। ‘বর্ধমান’ নাম নিয়ে গল্পও আছে। জৈন মহাবীর বর্ধমানে এলে বর্ধমানের কিছু লোক নাকি কুকুর লেলিয়ে দেন। জনশ্রুতি, সেই মহাবীরেরই নামে অঞ্চলের নাম হয় বর্ধমান। মুসলমান আমলে শের আফগান আর সুন্দরী মেহরুন্নিসার কাহিনি আর শের আফগানের কবরে ইতিহাস এখনও কথা কয়।
প্রস্তুত: নতুন জেলার জন্য। দুর্গাপুরের গাঁধী রোডে। ছবি: বিকাশ মশান
তবে আধুনিক বর্ধমানের পত্তন রাজবংশের ইতিহাস দিয়ে। লাহৌরের কোটলি মহল্লার আবুরাইয়ের ঠাকুরদা সঙ্গম রাইয়ের হাতে এই বংশের পত্তন। তবে শেষমেশ দত্তক পুত্ররাই এই বংশকে শাসন করেছেন। এখানে তখন ভাস্কর পণ্ডিতের বর্গির হাঙ্গামা। কিছু দিন পরে ইংরেজও চলে এল, শাসক রূপে। তিলকচাঁদের আমলে কালনা গুরুত্ব পেল। বর্ধমানের পাশে গঙ্গা নেই। তাই কালনা হল দ্বিতীয় রাজধানী। কালনা, ভাবারডিহি, গুপ্তিপাড়ায় নির্মিত হল নানা মন্দির। যোগাদ্যার মন্দির, জগৎগৌরীর মন্দির তো বিখ্যাত। ‘চণ্ডীমঙ্গলে’ পূর্ব বর্ধমানও বিশেষ উল্লিখিত। কমলাকান্ত থেকে কুমুদরঞ্জন বা কালিদাসের কবিতাতেও মুখর হল বর্ধমান।
১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলনে সমস্ত বর্ধমান জেলা ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে মুখর। কালনায় প্রতিষ্ঠিত হল জাতীয় বিদ্যালয়। ১৯৩১-এ সুভাষচন্দ্র বক্তৃতা দিতে এলেন বিদ্যাসাগরের ভালবাসার বর্ধমানের এক জনসভায়। ১৯৪২-এর আন্দোলনে সাড়া দিয়ে ১৭ অগস্ট বর্ধমান শহরে বের হল এক বিরাট শোভাযাত্রা। ১৩ সেপ্টেম্বর কালনায় হরতাল। চৈতন্যের দীক্ষাভূমি কাটোয়াও উত্তাল। ২৬ সেপ্টেম্বর কালনায় উড়ল জাতীয় পতাকা। এর পরে ১৯৪৭-এ এল স্বাধীনতা।
স্বাধীন ভারতে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বর্ধমান ধান্য-শস্য উৎপাদনে ইতিহাস সৃষ্টি করল। আয়তনের দিক থেকে তৃতীয় বৃহত্তম জেলা হিসেবে সাতটি মহকুমা, প্রায় ৩৫টি থানা এবং প্রায় সমসংখ্যক ব্লক নিয়ে। পঞ্চায়েত সমিতি, পৌনে তিনশো গ্রাম পঞ্চায়েত, চার হাজার গ্রাম সংসদ নিয়ে প্রশাসনিক কাজ চলতে থাকল। বাঁকা, গাঙ্গুড়, বেহুলা, কানা, খড়ি, কুনুর নদী বয়ে চলেছে শস্যভাণ্ডারকে পূর্ণ করে। বনকাপাসি, পাটুলি, কাটোয়া, ভাতারের হস্তশিল্প বিখ্যাত। বর্ধমান, কাঁকসা, মেমারিতে গড়ে উঠল ক্ষুদ্রশিল্প। তৈরি হল মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।
কাটোয়া, কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট, কালনা, মন্তেশ্বর, ভাতার, মেমারির ইতিহাসে জড়িয়ে কতই স্মৃতি। এই জেলাতেই রামমোহন রায় দ্বিতীয় বিবাহ করেন। ১৯৩৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান শহরে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এসেছেন তাঁর পিতাও। চিত্তরঞ্জন দাশ ও জওহরলাল নেহরুও এসেছেন। ‘গঙ্গার শোভা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন কালনার। সর্বমঙ্গলা মন্দির, ১০৮ শিবমন্দির, কালো মসজিদ, শাহি মসজিদ, শহরের খ্রিস্টান গির্জার আশ্চর্য সহাবস্থানে বর্ধমান বস্তুতই বর্ধমান। এখানেই গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য প্রথম বাংলা পত্রিকা এবং ‘অন্নদামঙ্গল’ (১৮১৫) ছেপেছিলেন।
এখন সীতাভোগ আর ল্যাংচার বর্ধমান বিভক্ত হচ্ছে। প্রশাসনিক সুবিধে তো আছেই, যোগাযোগও বাড়বে। দূরস্থান আসবে নিকটে। জনসাধারণ প্রত্যাশা করে থাকেন, ভাগাভাগিতে মঙ্গলটা যদি অনিবার্য ভাবে এসে যায়, চাকরির সংস্থান হয়, শিক্ষার প্রসার ঘটে, কাটোয়ায় যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি রূপ পায়। ভরসা তো রাখতেই হয়!
লেখক বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy