Advertisement
E-Paper

ডাইনি অপবাদ দিয়ে টানা হুমকি, কটূক্তি

এক দশকেরও বেশি আগে খাতায় কলমে পূর্ণ সাক্ষর হয়েছে বর্ধমান জেলা। অথচ এ জেলারই এক গৃহবধূকে ডাইনি অপবাদ ঘাড়ে নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে নিজের বাড়ি ছেড়ে। কারণ গ্রামে থাকলেই ওই পরিবারকে হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৬ ০০:১৮
তালা বন্ধ কেশবপুর গ্রামে ওই দম্পতির বাড়ি। নিজস্ব চিত্র।

তালা বন্ধ কেশবপুর গ্রামে ওই দম্পতির বাড়ি। নিজস্ব চিত্র।

এক দশকেরও বেশি আগে খাতায় কলমে পূর্ণ সাক্ষর হয়েছে বর্ধমান জেলা। অথচ এ জেলারই এক গৃহবধূকে ডাইনি অপবাদ ঘাড়ে নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে নিজের বাড়ি ছেড়ে। কারণ গ্রামে থাকলেই ওই পরিবারকে হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ। এই অবস্থায় প্রাণের ভয়ে ওই বধূ নিজের স্বামী ও ছেলেকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন পাশের গ্রামের এক আত্মীয় বাড়িতে।

যে এলাকার এই ঘটনা, সেই কালনা ১ ব্লকের বাঘনাপাড়া পঞ্চায়েতের কেশবপুর গ্রামটি কালনা সদর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে। এই জেলার কিছু কিছু অংশে এখনও কুসংস্কার কতটা গভীরে শিকড় গেড়ে আছে, তা এই ঘটনায় আরও এক বার স্পষ্ট হল বলে মনে করছে জেলা প্রশাসনের একাংশ। শুক্রবার ওই দম্পতিকে তাঁদের বাড়িতে ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা চালিয়েও গ্রামবাসীদের একাংশের প্রতিরোধে ব্যর্থ হয় ব্লক প্রশাসন। তবে, গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘাতের পথে না গিয়ে তাঁদের বুঝিয়ে এবং মন থেকে কুসংস্কার দূর করে ওই দম্পতিকে গ্রামে ফেরানোর বন্দোবস্ত করতে চায় প্রশাসন।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রের খবর, কেশবপুর গ্রামের এক কোণে দীর্ঘদিন ধরে বাস করছে কোঁড়া সম্প্রদায়ের ১৮টি পরিবার। এদের মধ্যে শিক্ষার আলো তেমন ভাবে পড়েনি। যদিও গ্রামে প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। যে বধূকে ডাইনি অপবাদে গ্রামছাড়া করা হয়েছে, তাঁর শ্বশুরবাড়ি বছর খানেক আগে পঞ্চায়েতের দেওয়া ইন্দিরা আবাস যোজনায় ইটের বাড়ি তৈরি করেছে। সে বাড়িতে বর্তমানে ঝুলছে তালা। ওই দম্পতি পেশায় খেতমজুর। মাস চারেক আগে থেকেই পাড়ার বাসিন্দারা ওই বধূকে ডাইনি বলে অপবাদ দিতে শুরু করেন। এলাকায় অশুভ শক্তি মাথা চারা দেওয়ায় রোগ বালাই তো বটেই, মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে— এই অজুহাত দেখিয়ে ওই বধূকে ডাইনি সাব্যস্ত করা হয়। বলা হতে থাকে, বাড়িতে থাকা একটি মনসা গাছকে ঘিরে যাবতীয় অমঙ্গল ঘটানো হচ্ছে। ভিন্‌ রাজ্যে কাজ করা তরণী মণ্ডল নামে এক যুবক সম্প্রতি গ্রামে এসে মারা যাওয়ার কারণ হিসাবেও ওই বধূকেই দায়ী করেন কোঁড়াপাড়ার লোকজন।

শুক্রবার আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ওই বধূ বলেন, ‘‘প্রথম প্রথম শুধু মুখে আমাকে ডাইনি বলত। কলতলায় গেলেও বাকিরা ডাইনি বলে কটূক্তি করত। ধীরে ধীরে জল নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। গ্রামের লোকজন মেলামেশা করাও ছেড়ে দেয়।’’ তাঁর অভিযোগ, সপ্তাহ খানেক আগে থেকে তাঁর উপরে চাপ বাড়ান প্রতিবেশীরা। তাঁকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া শুরু হয়। বারবার প্রতিবাদ করেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। উল্টে কয়েক জন তাঁর বাড়ির একটি দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়। ওই বধূর স্বামীর কথায়, ‘‘পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছিল, তাতে গ্রামে থাকা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই স্ত্রী আর বছর বারোর ছেলেকে নিয়ে কাছাকাছি এলাকায় এক আত্মীয়র বাড়িতে গিয়ে উঠি।’’

এর পরে ওই বধূ সমস্ত ঘটনা জানান বাঘনাপাড়া পঞ্চায়েতকে। পরে তিনি লিখিত অভিযোগ করেন কালনা থানায়। গ্রামবাসীর একাংশের মনে যে এখনও অযৌক্তিক কিছু কুসংস্কার বাসা বেঁধে আছে, তা মেনে নিয়েছেন বাঘনাপড়া পঞ্চায়েতের প্রধান, তৃণমূলের জগবন্ধু পাত্রও। তাঁর কথায়, ‘‘ওই পরিবারটিকে ফেরানোর জন্য বারবার ওই বাসিন্দাদের পঞ্চায়েতের তকফে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু, ওরা কিছুতেই মানতে রাজি নয়।’’

এর পরে পঞ্চায়েত মারফতই ওই বধূর ডাইনি অপবাদে বাড়ি ছাড়ার ঘটনাটি পৌঁছয় বিডিও (কালনা ১) অসীম কুমার নিয়োগীর কানে। বিষয়টি মেটাতে তৎপর হন অসীমবাবু। এ দিন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে ওই দম্পতির সঙ্গে কথা বলেন বিডিও। তাঁরা বিডিওকে জানান, কোনও অন্যায় না করেও স্রেফ প্রাণের ভয়ে তাঁরা গ্রামছাড়া হয়েছেন। তাঁরা যে কোনও অশুভ কাজের সঙ্গে যুক্ত নন, এ কথা গ্রামবাসীদের বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে লাভ হয়নি। বিডিও-র কাছে ওই কোঁড়া দম্পতি এ-ও দাবি করেন, গত বছর ইন্দিরা আবাস যোজনায় ইটের বাড়ি তৈরি করার পর থেকেই বাসিন্দাদের একাংশ হিংসার জেরে ডাইনির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাঁদের গ্রামছাড়া করেছে। দম্পত্তির কথা শুনে বিডিও বিকেলেই কেশবপুর গ্রামে গিয়ে ওই বাসিন্দাদের বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেন।কিন্তু গ্রামের শঙ্কর ওঁরাও, শ্রীদাম ধারা, আদুরি কোঁড়া, নমিতা সর্দাররা বিডিও এবং পুলিশকর্মীদের জানিয়ে দেন, ওই বধূকে এলাকায় ফেরানো হলে তাঁরা গ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন। গ্রামবাসীদের অনড় মনোভাবে শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে প্রশাসনিক দলকে।

বিডিও পরে বলেন, ‘‘আজ হয়তো পারিনি ঠিকই। তবে বাড়ি ছাড়া ওই দম্পত্তিকে দ্রুত গ্রামে ফেরানোর উদ্যোগ নানা দিক থেকে শুরু হয়েছে।’’

Witch
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy