Advertisement
০২ মে ২০২৪

রাতভর লাঠি হাতে তৈরি উচিতপুর

গ্রামে ঢোকার মুখেই রাস্তা আটকে মোটা লাঠি হাতে দাঁড়িয়েছিলেন বেশ কয়েকজন মহিলা। কৌতুহলী মুখে দেখেই বলে উঠলেন, ‘‘আমাদের দলের লোককে মেরে ফেলার পরে রাতে গ্রামেও হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল তৃণমূল। সারা রাত পাহারা দিয়েছি।’’

নিহত স্বপন মালিকের দেহ নিয়ে সিপিএমের মিছিল।উদিত সিংহের তোলা ছবি।

নিহত স্বপন মালিকের দেহ নিয়ে সিপিএমের মিছিল।উদিত সিংহের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
রায়না শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:৫৮
Share: Save:

গ্রামে ঢোকার মুখেই রাস্তা আটকে মোটা লাঠি হাতে দাঁড়িয়েছিলেন বেশ কয়েকজন মহিলা। কৌতুহলী মুখে দেখেই বলে উঠলেন, ‘‘আমাদের দলের লোককে মেরে ফেলার পরে রাতে গ্রামেও হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল তৃণমূল। সারা রাত পাহারা দিয়েছি।’’

এক দিকে, স্বজন হারানোর শোক আর এক দিকে ঘর সামলানোর তাড়া— দুইয়ে মিলে লাঠিসোঁটা নিয়েই রাতভর প্রস্তুত ছিলেন রায়নার উচিতপুর গ্রামের বাসিন্দারা। জানালেন, খাদ্য সুরক্ষার কার্ডের সঠিক বিলিবন্টনের দাবিতে মিছিলে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কয়েকজনের বোমাবাজিতে দলের সক্রিয় কর্মী স্বপন মালিককে হারিয়ে থতমত খেয়ে গিয়েছেন গ্রামের অনেকেই। তাঁদের কথায়, তৃণমূল আসলে সিপিএমকে নয় সাধারণ মানুষকে ভয় দেখাতে চেয়েছে। এলাকার কিছু ব্যবসায়ীও মনে করছেন, ‘‘তৃণমূলের উদ্দেশ্য, যাঁরা দু’মুঠো চালের দাবিতে এই মিছিলে এসেছিলেন, তাঁরা যেন পথে না নামেন।”

সিপিএম কর্মীদের অভিযোগ, রায়নার বেশ কিছু গ্রাম তাঁদের কাছে ‘অবরুদ্ধ’ হয়ে রয়েছে, যেখানে গত কয়েক বছর ধরে লাল পতাকা ওড়েনি। এমনকী গত লোকসভা নির্বাচনেও বেশ কিছু গ্রামে সিপিএম প্রচার করতে পারেনি। কিন্তু এ বার জাঠাকে কেন্দ্র করে সিপিএম ছোট-বড় জমায়েত করে মিছিল করেছে। কোথাও কোথাও আক্রমণ হলেও তা প্রতিরোধও করা গিয়েছে। গত ১ অক্টোবর বর্ধমানগামী রায়নার বাস শহরে ঢুকতে দিতে হবে এই দাবি পথে নামলে সিপিএমের উপর আক্রমণ করা হয়। সিপিএমের রায়নার জোনাল কমিটির নেতা সহ বেশ কয়েকজন তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হন বলে অভিযোগ। বিধানসভা নির্বাচনকে কমিশন সক্রিয় হতেই সিপিএমও রায়না-খন্ডঘোষকে ফের নিজেদের হেফাজতে রাখার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। তারই কর্মসূচীর জন্য ১০০ দিনের কাজের দাবিতে কিংবা খাদ্য সুরক্ষা কার্ডের সঠিক বন্টনের দাবিতে বিডিও-র কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার রায়নার শ্যামসুন্দরে খাদ্য সুরক্ষার মিছিলেই তৃণমূলের লোকেরাই হামলা বলে অভিযোগ। কলেজের ছাত্রাবাস থেকে ছোড়া বোমায় বহু সিপিএম কর্মী আহত হন। মারাও যান এক জন। এরপরেই পাল্টা হামলার ভয়ে রাতভর তৈরি ছিল নিহত সিপিএম কর্মীর গ্রাম উচিতপুর।

শ্যামসুন্দর কলেজের এই ছাত্রাবাসের ছাদ থেকেই বোমা ছোড়া হয় বলে অভিযোগ

সিপিএমের অভিযোগ, বৃহস্পতিবার শ্যামসুন্দরে ব্লক দফতর থেকে ফেরার পথে গুনোট গ্রামে অভিযুক্ত দীপ দত্তই প্রথম ঝামেলা পাকায়। শুধু কলেজে নয়, এলাকাতেও নানাভাবে ‘দাদাগিরি’ করত সে। শুক্রবারও দীপের বিরুদ্ধে বারেবারে স্লোগান দিতে দেখা যায় সিপিএম কর্মীদের। আবার দীপের পরিবারের দাবি, উচিতপুর গ্রামের সিপিএম কর্মীরা তাঁর বাড়িয়ে গিয়ে হুমকি দিয়ে এসেছেন। দীপের মা রুবিদেবী শুধু বলেন, “দীপ কলেজে গিয়েছিল। সেখানে কী হয়েছিল তা তো বলতে পারব না।” কলেজের আরেক প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদকের নামেও অভিযোগ করেছে সিপিএম।

তবে এখন দলের কর্মীরা যাই করুন, নিহত স্বপনবাবুর পরিবার শোক সামলাতে পারছেন না কিছুতেই। তাঁর পরিজনেরা জানান, কয়েক মাস আগে রায়নার সেহেরাবাজারের নেতাজি মোড়ে ছোট ছেলে ঝন্টু পথ দুর্ঘটনায় মারা যান। তারপর থেকে স্বপনবাবুর স্ত্রী মালতীদেবী মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন।

শুক্রবার গিয়ে দেখাগেল কেমন যেন অগোছালো, স্থবির হয়ে গিয়েছেন তিনি। পরিজনেরা জানান, দেহ আসার আগে পর্যন্ত তাঁর স্ত্রী মালতীদেবী জানতেন না, স্বামী মারা গিয়েছেন। এ দিনও খবর শুনে, স্বামীকে দেখে কেমন যেন স্থিতি হারিয়ে ফেলেন তিনি। নিহতের মা বাসনাদেবী বাড়ির বাইরে রাস্তায় কেঁদেই চলেছেন। পেশায় সব্জি বিক্রেতা স্বপনবাবুর দু’কামরার খড়ের চালের মাটির বাড়ি। বড় ছেলে পিন্টুবাবু বলেন, “আমরা খুব গরীব। বাবা সাইকেল নিয়ে গ্রামে গ্রামে সব্জি বিক্রি করেন। আর আমি মোটর ভ্যান চালিয়ে কোনও রকমে সংসার চালাই।” গ্রামবাসীদেরও কথায়, খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেল পরিবারটি।

পরিস্থিতি যে সত্যিই কঠিন, তার খানিকটা টের মিলেছে বৃহস্পতিবার সন্ধেতেই। অভিযোগ, দলীয় কর্মীর মৃত্যুর খবর পেয়ে সিপিএমের লোকেরা তৃণমূলের উপর তান্ডব চালায়। তৃণমূলের দাবি, ওই গ্রামের ১৫টি বাড়ি, উচিতপুর মোড়-সহ আশেপাশের কয়েকটি দোকান ভাঙচুর চালায় সিপিএম। তাঁদের ‘ভয়ে’ অনেকে দোকান পর্যন্ত খুলতে পারেনি। আবার সিপিএমের সমর্থকদের দাবি, পুলিশ আর তৃণমূলের ভয়ে রাতভর গ্রাম পাহারা দিয়েছেন তাঁরা। সিপিএমের কয়েকজন কর্মী বলেন, “রাতে বেশ কয়েকগাড়ি পুলিশের গাড়ি গ্রামে ঢুকছিল। সামনে মহিলাদের রেখে লাঠি হাতে দাঁড়াতেই উচিতপুরের মোড় থেকে র্ধমানের দিকে ঘুরে যায়।’’

শুক্রবার সকালে শ্যামসুন্দর-করল্ল্যাঘাট রাস্তা ধরে সাঁকটিয়া পেরোতেও দেখা যায়, বাঁ দিকে মোরাম রাস্তা চলে গিয়েছে সোজা উচিতপুরে। দু’ধারে পতপত করে উড়ছে লাল পতাকা। তৃণমূলের পতাকা কার্যত নেই।

ওই রাতে পুলিশের গাড়িতে থাকা এক আধিকারিকও বলেন, “উচিতপুরের দিকে যেতেই গ্রামবাসীরা লাঠি উঁচিয়ে এগিয়ে আসেন। চিৎকার করতে থাকেন। অশান্তি বাড়বে গ্রামের বাইরেই টহল দিয়েছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Raina village Bardhaman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE