যে এলাকাগুলিতে ‘ভোট লুঠের’ অভিযোগ উঠেছিল সবচেয়ে বেশি, ফল প্রকাশের পরে সেখানেই তত বেশি ব্যবধানে এগোল তৃণমূল। তবে বিরোধীদের সমস্ত সন্দেহকে নস্যাৎ করে তৃণমূলের দাবি, মানুষ আমাদের ঢেলে ভোট দিয়েছেন।
৩০ এপ্রিল বর্ধমান পূর্ব লোকসভা কেন্দ্রের ভোটে মঙ্গলকোটের ৫৬টি, কেতুগ্রামের ৫৭টি, রায়নার ৫৩টি ও জামালপুরে ১৮টি বুথে ভোটারদের ভয় দেখানো, বুথ দখল ও ছাপ্পার অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। এমনকী ১২ মে পুনর্নির্বাচনের দিনেও মঙ্গলকোটের ১৪ (দেবগ্রাম) ও ৫৩ (চাকদহ) নম্বর বুথ নিয়ে অভিযোগ ওঠে। সে দিন চাকদহ গ্রামের বুথে ভোট প্রক্রিয়া সঠিক ভাবে চালাতে পারেননি বলে প্রিসাইডিং অফিসার শরবিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নির্বাচন কমিশন সরিয়ে দেয়। ওই দিনই সে দিন টিভির পর্দায় দেখা যায়, ভোট কক্ষের ভিতর ওই এলাকার তৃণমূলের যুব নেতা সোনা শেখ এক মহিলাকে নিয়ে গিয়ে ভোট দেওয়াচ্ছেন। ভোটকর্মীরাও জানিয়েছিলেন, মানসিক প্রতিবন্ধী ও অন্ধ ভোটার বলে একের পর এক ‘অ্যাকোম্পানি’ ভোট দেওয়ার জন্য অযথা ‘চাপ’ তৈরি করা হচ্ছে। ফল ঘোষণার পরে দেখা যাচ্ছে, চাকদহ বুথে ৫০৬ জন ভোটারের মধ্যে তৃণমূল একাই পেয়েছে ৪১৭টি ভোট (৮২%)। আর সেখানে সিপিএম পেয়েছে ৭৩টি ভোট (১৪%)। রায়নাতেও ৩৩, ৬৯৫ ভোটে জিতেছে তৃণমূল।
ভোটের দিন দুপুর গড়াতে না গড়াতেই রায়না ও জামালপুরের অসংখ্য বুথে শতকরা ৬০ থেকে ৮০ ভাগ ভোট পড়ে গিয়েছিল। সিপিএম ৫৪টি বুথে পুনর্নির্বাচন দাবি করলেও, তৃণমূল সূত্রের খবর প্রায় ৮০টি বুথ দখল হয়েছিল। ফলাফল ঘোষণার পরে দেখা যায়, রায়নার হিজলনা এফপি বিদ্যালয়ের বুথে সিপিএম যেখানে ২১টি ভোট পেয়েছে, তৃণমূল পেয়েছে ৯৪৪টি। জ্যোতসীলামের বুথে সিপিএম ৪০টি, তৃণমূল ৮৪২টি, বেলসরে সিপিএম ২৩, তৃণমূল ৫৮১, জ্যোৎসাদিতে সিপিএম ২৮ তৃণমূল ৬৫৮অন্তত শতাধিক বুথ মেলে যেখানে সিপিএম ৮০-৯০ টা ভোট পেয়েছে। আর তৃণমূল পেয়েছে ৬০০ থেকে ৭০০টা।
জামালপুরের কমলপুরের ২৩ নম্বর বুথেও সিপিএম পেয়েছে ৩৪টি ভোট, আর তৃণমূলের ঝুলিতে ৯৮৭। দক্ষিণ সাহারানপুরের ২৯ নম্বর বুথে সিপিএম ৮১, তৃণমূল ৫০১, দক্ষিণপুর ২৩০ নম্বর বুথে সিপিএম পেয়েছে ২৬টি ভোট, তৃণমূল পেয়েছে ৬৩৫। সিপিএমের বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদক অমল হালদারের দাবি, “সকালে খুব বেশি হলে এক ঘণ্টা রায়না-জামালপুরের বুথগুলিতে স্বাভাবিক ভোট হয়েছিল। তারপরেই ছাপ্পা মারতে শুরু করে তৃণমূল।”
তৃণমূল অবশ্য এই বুথ দখল করে ছাপ্পার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বধর্মান পূর্ব কেন্দ্রের তৃণমূলের ভোটের দায়িত্বে থাকা জেলা নেতা উত্তম সেনগুপ্ত বলেন, “২০০৮ সালের আগে সমস্ত নির্বাচনে এমনই দৃশ্য দেখা যেত। আমরা বুথে-বুথে মাত্র ২-৪টি ভোট পেতাম। সিপিএম বাদবাকী সাত-আটশো ভোট পেত। তখন আমরা বলতাম, সন্ত্রাস। সিপিএম বলতো, মানুষের জয়। এ বার ওরা বুথ দখলের অভিযোগ তুলছে, আমরা বলছি, এটা মানুষের স্বতস্ফূর্ত সাড়া।” জামালপুরের তৃণমূলের বিধায়ক উজ্জ্বল প্রামানিক বলেন, “জামালপুরের চৌবেড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৭ নম্বর বুথে শতকরা ৯৫ ভাগ ভোট পড়েছিল দেখে নির্বাচন কমিশন নতুন করে ভোট নেয়। পরের ভোটে তো শতকরা ৯৬ ভাগ ভোট পড়েছিল। এ থেকেই প্রমান হয়, মানুষ ওখানে আমাদের ঢেলে ভোট দিয়েছেন।”
তবে প্রচারপর্ব থেকেই রায়নায় জয় নিশ্চিত করার চাপ ছিল তৃণমূলের। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় সভা করে বারবার নেতা-কর্মীদের বলেছিলেন, গত বিধানসভা বা লোকসভায় রায়না আমাদের তরফে ছিল না। মানুষ বারবার প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ বার জিততেই হবে। নেতাদেরও অর্ন্তদ্বন্দ্ব ভুলে একসঙ্গে কাজ করার কথা বলা হয়েছিল। এমনকী গোপন বৈঠকে আগেই জানানো হয়েছিল যে ফল ভাল না হলে অপসারণ করা হতে পারে, বলেও দলেরই একাংশের খবর। ভোটের দিনে একাধিক নেতা খোলাখুলি স্বীকারও করেছিলেন, প্রচুর বুথ দখল করে দলের জয়ের ব্যবধান বাড়াতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন, নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই।
মঙ্গলকোট-কেতুগ্রামের পরিসংখ্যান দেখলেও প্রায় একই ছবি উঠে আসে। মঙ্গলকোটের বৈধ ভোটের ৩৪.৪৪ শতাংশ পেয়েছে সিপিএম আর তৃণমূল পেয়েছে ৪৭.৫২ শতাংশ। কেতুগ্রাম বিধানসভায় সিপিএমের প্রাপ্ত ভোট ২৯ শতাংশ আর তৃণমূলের ৪৭.৬৩ শতাংশ। সিপিএম ও কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ, “বুথ ভিত্তিক হিসেবে যে গড়মিল ধরা পড়ছে তা হিমশৈলের চূড়া। সাধারণ মানুষকে বুথের আগে যেভাবে তৃণমূল আটকে দিয়েছে, তা তো প্রকাশ পাচ্ছে না।”
মঙ্গলকোটের অন্তত ২০টি বুথে সবচেয়ে বেশি একপেশে ভোটের অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলকোটের ৭২ নম্বর বুথে মোট ভোটার ৯০৭, তৃণমূল একাই পেয়েছে ৮১৩টি। সিপিএম, বিজেপি ও কংগ্রেসের ভোট যথাক্রমে ৩৮, ২৮ ও ২৬টি। মঙ্গলকোটের সিপিএমের বিধায়ক শাহজাহান চৌধুরীর গ্রাম ধারসোনাতেও একই হাল। ২২২ নম্বর বুথে ৩০৪টি ভোটের মধ্যে তৃণমূলের ঝুলিতে ২৭৮টি ভোট। কংগ্রেস একটাও ভোট পায়নি। মঙ্গলকোটের কংগ্রেস নেতা জগদীশ দত্তের অভিযোগ, “কোনও বুথে একটাও ভোট পাবে না কংগ্রেস, এটা কী বাস্তবসম্মত! তৃণমূল ভোট লুঠকে শিল্পের পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছে।”
কেতুগ্রামের বহু বুথেও একই চিত্র। বিরুরির (৩৫) বুথে ৭৫৬ জন ভোটারের মধ্যে ৭০৭টি পেয়েছে তৃণমূল, বিজেপি ও কংগ্রেস ৭টি করে আর সিপিএম পেয়েছে ৩৫টি। কচুটিয়াতে ৭৫১টি ভোটের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ৭০০টি, সিপিএম পেয়েছে ৩৮টি। সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য তথা প্রাক্তন বিধায়ক তমাল মাঝির অভিযোগ, “আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে যে অভিযোগ করেছিলাম, তা যে কতটা সত্য ফলাফল দেখেই বোঝা যাচ্ছে।” যদিও তৃণমূলের কেতুগ্রামের বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজ বলেন, “নির্বাচন কমিশনের কড়া নজরে ভোট হয়েছে। সাধারণ মানুষ নিজের মত প্রকাশ করেছেন। আমাদের উন্নয়ন দেখে মানুষ আমাদের আশীর্বাদ করেছেন। যারা রিগিং বলে চিৎকার করছেন, তাঁরা আসলে মানুষকেই অপমান করছেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy