Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

পাড় ভাঙছে ভাগীরথীর, ঘুম নেই গ্রামের

মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় ইচ্ছাময়ীর। মনে হয়, এই বুঝি তলিয়ে গেল ঘর-বাড়ি। চোখ রগড়ে উঠে বাইরেটা দেখে বুকে বালিশ চেপে আবার ঘুমোনোর চেষ্টা করেন। শুধু ইচ্ছাময়ী নন আতঙ্কে রাত কাটে অগ্রদ্বীপের বেশিরভাগ বাসিন্দারই। ফের ভাগীরথীর ভাঙন শুরু হওয়ায় তাঁদের আশঙ্কা, কি জানি আবার কোনদিন বাস ওঠাতে হয়।

এভাবেই ভাঙছে পাড়। অগ্রদ্বীপ গ্রামে তোলা নিজস্ব চিত্র।

এভাবেই ভাঙছে পাড়। অগ্রদ্বীপ গ্রামে তোলা নিজস্ব চিত্র।

সৌমেন দত্ত
কাটোয়া শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৪ ০৮:০০
Share: Save:

মাঝরাতে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় ইচ্ছাময়ীর। মনে হয়, এই বুঝি তলিয়ে গেল ঘর-বাড়ি। চোখ রগড়ে উঠে বাইরেটা দেখে বুকে বালিশ চেপে আবার ঘুমোনোর চেষ্টা করেন।

শুধু ইচ্ছাময়ী নন আতঙ্কে রাত কাটে অগ্রদ্বীপের বেশিরভাগ বাসিন্দারই। ফের ভাগীরথীর ভাঙন শুরু হওয়ায় তাঁদের আশঙ্কা, কি জানি আবার কোনদিন বাস ওঠাতে হয়। দিনকয়েক আগে অগ্রদ্বীপের ভাঙন পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন মহকুমাশাসক মৃদুল হালদার। তাঁকে দেখে ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা অভিযোগ, মাসে অন্তত দু’বার সেচ কিংবা প্রশাসনের কর্তারা ভাঙন দেখতে এলাকায় আসেন। আশ্বাস দিয়ে ফিরে যান। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। মহকুমাশাসকের সামনেই ঘোষপাড়ার মুক্তিরানিদেবী জানান, বছর খানেক আগে ভাঙনের জ্বালায় পাকা বাড়ি ভেঙে তাঁরা এখানে উঠে এসেছিলেন। সেই বাড়ির ইট দিয়ে এই বাড়ি তৈরি করেন। কিন্তু এ বাড়ির দোরগোড়ায় চলে এসেছে ভাগীরথী। তিনি বলেন, “আর কোথাও গিয়ে বাড়ি করার ক্ষমতা নেই। ভবিতব্যে যা আছে, তাই হবে।” তাঁর মতো শতাধিক পরিবার ভাঙনের জন্য ঘোষপাড়া থেকে উঠে এসে বাঁধের গায়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। জায়গাটার নাম হয়ে গিয়েছিল নতুন ঘোষপাড়া। কিন্তু সেই আশ্রয়ও ফের ভাঙনের কবলে। সেচ দফতরের বর্ধমান ডিভিশনের সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়র ধীরাজ ধর বলেন, “অগ্রদ্বীপের জন্য কেন্দ্র সরকারের একটি প্রকল্পে বিস্তারিত তথ্য পাঠানো হয়েছে। আশা করছি, খুব দ্রুত ওই প্রকল্প অনুমোদন পাবে।”

অগ্রদ্বীপের নতুন ঘোষহাট থেকে খেয়াঘাট পর্যন্ত এলাকা ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত। অনেকেরই সদর দরজা থেকে ১০ ফুট দূরে আছড়ে পড়ছে ভাগীরথী। স্থানীয় তাপস ঘোষ, বাবু ঘোষেরা বলেন, “এ বার বাঁধেও ভাগীরথীর থাবা পড়েছে। বেশ কিছুটা অংশ তলিয়ে গিয়েছে।” এর আগে কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও সেচ দফতরের কর্তারা অগ্রদ্বীপের ভাঙন পরিস্থিতি ঘুরে দেখেন। মহকুমাশাসক বলেন, “অগ্রদ্বীপের ভাঙন পরিস্থিতি ভয়াবহ। সেচ দফতরের কর্তাদের কাছে রিপোর্ট পাঠিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হবে। একই সঙ্গে নদীর পাড়ে ভেরাভেরি গাছ লাগিয়ে ভাঙন রোধের চেষ্টা চালানো হবে ।”

সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার এক বহুজাতিক সংস্থাকে ভাগীরথীর ভাঙন রোধের দায়িত্ব দেয়। ‘জিও টেক্সটাইল’ পদ্ধতিতে ভাঙন রোধের চেষ্টা করে তারা। তাদের দাবি, ভারতে অগ্রদ্বীপেই ভাঙন রোধে ওই পদ্ধতি প্রথম প্রয়োগ করে তারা। কিন্তু কাজ হয়না। তারা জানায়, অগ্রদ্বীপের মাটির চরিত্রের জন্যই ওই পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে। পরে বাধ্য হয়ে সেচ দফতর ‘দেশি পদ্ধতি’তে বাঁশের খাঁচার মধ্যে বড় বড় পাথর ফেলে ভাঙন রোধে সচেষ্ট হয়।

সেচ দফতরের কিছু কর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বছর চারেক আগে অগ্রদ্বীপ গ্রামের একাংশে যখন ভাঙন শুরু হয়, উল্টো দিকে তখন চর তৈরি হচ্ছিল। ওই চর জেগে ওঠার পরে পশ্চিম পাড়ের চরবিষ্ণুপুর ভাঙনের কবলে পড়ে। অবস্থা এমন হয় যে, ২০১০ সালে জেলা পরিষদ চরবিষ্ণুপুর গ্রামকে পুনর্বাসন দিতে বাধ্য হয়। অন্য দিকে, অগ্রদ্বীপের ভাঙনগ্রস্ত এলাকায় পলি জমতে শুরু করায় ভাঙনের আশঙ্কা দূর হয়। অনেকেই ভেবেছিলেন, এ বার বোধ হয় দশ হাজার বাসিন্দার গ্রাম অগ্রদ্বীপ বেঁচে গেল। কিন্তু গত মে মাস থেকে ফের ভাঙন শুরু হওয়ায় এলাকাবাসী সঙ্কটে পড়েছেন। সেচ দফতরের কর্তাদের ধারনা, অগ্রদ্বীপের উল্টো দিকে তৈরি হওয়া চর বড় হয়েছে, ভাগীরথীও গতিপথ পাল্টেছে। ফলে অগ্রদ্বীপের পাড়ে সরাসরি জল ধাক্কা মারায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।

স্থানীয় ইচ্ছাময়ী ঘোষ, উন্নতি ঘোষ, ছবি ঘোষেরা বলেন, “ভাঙনের জন্য পুরনো জায়গা ছেড়ে পালিয়ে এসে নতুন জায়গায় ঘর বেঁধেছিলাম। কিন্তু ভয়ে রাতের পর রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারিনা। খালি মনে হয়, এই বুঝি বাড়িটা রাতের অন্ধকারে তলিয়ে গেল।”

গ্রামে গিয়েও দেখা গিয়েছে, বাঁধের একটা অংশের পাশাপাশি বোল্ডার গুলো নদীর পাড় থেকে খুলে পড়ছে। নতুন ঘোষপাড়ার বাড়িগুলো কার্যত পাড়ে ঝুলছে। পঞ্চায়েত কর্তারা জানান, ২০০৫ সালের অগস্টে বেথুয়াডহরী-অগ্রদ্বীপ রাজ্য সড়ক ভাগীরথীতে তলিয়ে যায়। অগ্রদ্বীপ ‘ভাঙন প্রবণ’ জায়গা বলেও চিহ্নিত হয়। ওই সময় এক রাত্রে প্রায় ২০০ ঘরকে সরিয়ে নিয়ে এনেছিল প্রশাসন। কিন্তু সেই পরিবারগুলি যেখানে ‘নতুন ঘর’ বেঁধেছিল সেই জায়গাও ভাগীরথীর হাতে আক্রান্ত। মহকুমাশাসকের কাছে অগ্রদ্বীপ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান নিতাই মুখোপাধ্যায়ের কাতর আবেদন, “এক্ষুনি অন্তত ১৫-২০টা বাড়িকে পুনর্বাসন দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।” কাটোয়া ২-এর বিডিও শিবাশিস সরকারকে এ ব্যাপারে একটি রিপোর্ট তৈরি করে জেলায় পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন মহকুমাশাসক মৃদুল হালদার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

soumen dutta katoa vagirathi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE