আসানসোলের জয়ী বিজেপি প্রার্থীর সঙ্গে জেলা বিজেপির সভাপতি নির্মল কর্মকার। ছবি: শৈলেন সরকার।
ঘামে ভেজা প্রায় বেরং পাঞ্জাবি। ঢোলা পাজামা আর ততোধিক ম্লান এক ঝোলা। সর্বক্ষণের বামপন্থী কর্মীর ছাপমারা আদল।
মেলাতে পারছেন না তো?
আসানসোলের সেন্ট ভিনসেন্ট স্কুলের গণনাকেন্দ্রের বাইরে প্রায় শুকনো কদমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে হাসছেন ভদ্রলোক।
আসলে কি জানেন, সংগঠন করলে চেহারায় একটা পোড় খাওয়া ছাপ পড়ে যায়। সে যে দলেরই হোক না কেন।
খনি-খাদানে ভরা আসানসোলের বিস্তীর্ণ এলাকায় গত চার দশকেরও বেশি বামেদের নিরঙ্কুশ আধিপত্যে বিজেপি প্রার্থীর থাবা বসানোর হিসেবটা মিলত না, তিনি না থাকলে। স্থানীয় বাম-ডান বিরোধীরাও অকপটে স্বীকার করছেন, ‘লোকটা করে দেখাল বটে!’
গণনাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে খোদ বাবুল সুপ্রিয়ও অকপট, “আমি গোল করেছি। কিন্তু কী করে গোল করতে হয়, সেটা শিখেছি ওঁর কাছেই।” কলকাতায় দলীয় কার্যালয়ে বসে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ কবুল করছেন, “আসানসোলের জয়টা ওঁকে ছাড়া ভাবতেই পারছি না।”
লাজুক মুখে তিনি শুধু বলছেন, “আমাকে নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করছেন!” বক্তার নাম নির্মল কর্মকার। বিজেপি-র বর্ধমান জেলা সভাপতি। গত আড়াই মাস ধরে চল্লিশ ডিগ্রি পারদ মাথায় যিনি কখনও পাণ্ডবেশ্বর, কখনও বা বারাবনি বা উখড়ার শ্রমিক কলোনি ঘুরে তৈরি করেছেন পদ্ম ফোটানোর আদর্শ জলাজমি।
আসানসোলে বিজেপি-র পতাকা পুঁতে দেওয়ার এই নেপথ্য কারিগরকে অবশ্য আগাম চিনেছিলেন রাহুলই। তাঁর কথায়, “দলের দায়িত্ব নেওয়ার পরেই মনে হয়েছিল, আসানসোলে একটা সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সংগঠন বেশ দুর্বল ছিল। খোলনলচে বদলাতে হবে।” সাংগঠনিক অদলবদলের পরে তাঁরই নির্দেশে জেলা সভাপতির পদ নিয়েছিলেন নির্মল।
প্রার্থী নির্বাচন পর্বে বাবুল কিন্তু আসানসোলে দাঁড়াতে আগ্রহী ছিলেন না। রাহুলের মনে পড়ে , “বাবুল অন্য জায়গা চেয়েছিল। আমিই ওঁকে বলি, আসানসোলে দাঁড়ান। ওখানে ভাল সংগঠক আছে।” আর নির্মলকে ডেকে তিনি বলেছিলেন, “দায়িত্ব আপনার। জিতলে আপনিই জিতবেন, হারলেও আপনি। উনি কথা রেখেছেন।”
কে এই নির্মল?
বাইশ বছর ধরে আরএসএস করা নির্মল কর্মকারের হাতেই এক সময়ে ছিল জেলা-সঙ্ঘের দায়িত্ব। বিভিন্ন সময়ে জেলা বিজেপি-রও নানা দায়িত্ব বর্তেছে তাঁর কাঁধে। বাবুলের কথায়, “শুধু রাস্তাঘাট নয়, কোথায় কোন গাছ, পুকুর আছে নির্মলদা তাও বলে দেবেন, নিখুঁত!” নিজের ব্যবসার সূত্রে স্থানীয় হিন্দিভাষী ও ব্যবসায়ীদের মন-মানসিকতা তাঁর নখদর্পণে। পরোপকারী স্বভাবের দৌলতে এলাকার সাধারণ মধ্যবিত্তের কাছেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা যথেষ্ট।
নির্মলের কথায়, “এলাকা চেনা। কোন এলাকায় কী সুবিধা-অসুবিধা জেনে সেই মতো কর্মীদের প্রচারের নির্দেশ দিয়েছিলাম। সংগঠনটাকে বাঁধতে একটু খাটতে হয়েছিল। গত কয়েক মাসে প্রায় একশো ভাগ বুথ কমিটিতে কর্মী নিয়োগ করে স্থানীয় মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব দিয়েছি। এই জয় এসেছে সেই সব নিচুতলার কর্মীদের জন্যই। তবে বাবুল এমন অমানুষিক পরিশ্রম এবং সহযোগিতা না করলে এই জয় সম্ভব হত না।”
শুধু বাবুলের মতো তারকা নয়। নরেন্দ্র মোদীকে আসানসোলে নিয়ে আসাটাও জরুরি ছিল। প্রাক-ভোট পরিস্থিতির রিপোর্ট নিয়মিত পাঠানো হত মোদী-ঘনিষ্ঠ জয়ন্তভাই কাপাডিয়ার কাছে। সেই তথ্যে সন্তুষ্ট হয়েই শেষমেশ উড়ে এসেছিলেন মোদী। দলীয় সূত্র বলছে, আসানসোল কেন্দ্রের একটা বড় সংখ্যক ভোট শেষ মুহুর্তে পদ্মমুখী হয়েছে এই কারণেই।
নির্মল আপাতত পাখির চোখ করেছেন জুনে আসানসোল পুরভোট। তার জন্য তিনটি কোর কমিটি গড়া হচ্ছে। বাম, এমনকী ডান শিবিরেরও বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে দলে টানতে পারবেন বলে তাঁর আশা।
“সংগঠন মজবুত হলেই দেখবেন সব হিসেব এমনিই মিলে যাবে” প্রাণ খুলে হাসছেন নির্মল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy