Advertisement
২৩ মে ২০২৪
বালি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য/১

বালির ট্রাকের দাপটে দফারফা ২৫ গ্রামের রাস্তা

সরকার অনুমোদিত খাদান রয়েছে ৬টি। অথচ চলছে তার প্রায় দশগুন। আর শুধু তো বালি তোলা নয়, প্রতিদিন একই পথে হাজার হাজার বালিবোঝাই ট্রাকের যাতায়াত। ফলে খণ্ডঘোষের দামোদর নদের পাশে পলেমপুর থেকে নবগ্রাম পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার রাস্তা বেহাল হয়ে পড়ে রয়েছে। বিপর্যয় নেমেছে ওই রাস্তার পাশে প্রায় ২৫টি গ্রামের জনজীবনেও।

একটু বৃষ্টিতেই কাদা জমেছে কামালপুরের কাছে ওই ভাঙা রাস্তায়। ছবি: উদিত সিংহ।

একটু বৃষ্টিতেই কাদা জমেছে কামালপুরের কাছে ওই ভাঙা রাস্তায়। ছবি: উদিত সিংহ।

রানা সেনগুপ্ত
খণ্ডঘোষ শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৪ ০৭:৫৫
Share: Save:

সরকার অনুমোদিত খাদান রয়েছে ৬টি। অথচ চলছে তার প্রায় দশগুন।

আর শুধু তো বালি তোলা নয়, প্রতিদিন একই পথে হাজার হাজার বালিবোঝাই ট্রাকের যাতায়াত। ফলে খণ্ডঘোষের দামোদর নদের পাশে পলেমপুর থেকে নবগ্রাম পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার রাস্তা বেহাল হয়ে পড়ে রয়েছে। বিপর্যয় নেমেছে ওই রাস্তার পাশে প্রায় ২৫টি গ্রামের জনজীবনেও।

২০০৫ সালে প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনা প্রকল্পে পলেমপুর থেকে নবগ্রাম পর্যন্ত এই ২৫ কিলোমিটার রাস্তাটি তৈরি হয়। এলাকাবাসীদের দাবি, ওই এলাকায় সরকারি অনুমোদিত ৬টি বাসি খাদান তো রয়েইছে। তাছাড়াও আরও গোটা পঞ্চাশেক অবৈধ বালি খাদান চলে। ফলে প্রতিদিনই প্রচুর বালিবোঝাই ট্রাক ওই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভারি ট্রাকের যাওয়াআসায় ভেঙেচুরে যাচ্ছে রাস্তাটি। কোথাও এক-দেড় ফুটের গর্ত তার উপর কাদা, জল, সর্বোপরি দুর্ঘটনায় আশঙ্কায় চলাফেরাই দায় হয়ে পড়েছে বাসিন্দাদের। রাস্তা সারানোর দাবিতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গণসাক্ষর করা দরখাস্তও পাঠিয়েছেন তাঁরা। আবেদন গিয়েছে জেলা পরিষদের সভাধিপতি, পঞ্চায়েত সমিতি, পঞ্চায়েত প্রধান ও বিডিও-র কাছেও। কিন্তু সেভাবে কোনও সাড়াই মেলেনি বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ।

তাঁরা আরও জানান, এই দু’দিনের ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে রাস্তা আর মাঠের কোনও তফাত কার্যত নেই। তার মধ্যেও দ্রুত গতিতে যাতায়াত করছে ১০ চাকার ট্রাক। স্থানীয় কামালপুরের বাসিন্দা নিতাই সাহা বলেন, “শুনেছি এ বছর এই রাস্তায় চলাচলকারী বালিবোঝাই লরিগুলির কাছ থেকে শুল্ক বাবদ প্রায় ১ কোটি ৭১ লক্ষ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা পড়েছে।” তাঁর অভিযোগ, রাতদিন ট্রাকের যাতায়াত লেগেই আছে। প্রচুর করও উঠছে। আর আমরা পথ চলতে গিয়ে মারা পড়তে বসেছি।” কামালপুরের আরেক বাসিন্দা সনৎ সিংহ বলেন, “কিছুদিনের মধ্যেই এই রাস্তায় তিনজনের প্রান গিয়েছে বালিবোঝাই ট্রাকের ধাক্কায়। তার মধ্যে গৈতনপুরের এক গর্ভবতী মহিলাও ছিলেন। তিলডাঙার এক ভ্যানচালক ও মোল্লাপাড়ার বাসিন্দা আরেক মহিলার মৃত্যুও হয়েছে ট্রাকের চাকায় পিষে।”

পলেমপুরের শেখ সাহেবজান ও শেখ তাজউদ্দিনের দাবি, “আমাদের ছেলেমেয়েরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে। ট্রাকের দৌরাত্ম্যে রাস্তা এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে যে পাথর ছিটকে গায়ে-মাথায় লাগে। সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।’’ ফলে আশপাশের গ্রামের অনেকেরই স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে তাঁর দাবি। স্থানীয় খালপাড়ার বাসিন্দা শেখ বদলুও বলেন, “দু’বছর ধরে ওই রাস্তা যান চলাচলের অনুপযোগী।” তাঁর দাবি, “অন্য গ্রামের মানুষ তো ওই রাস্তার পাশের ২৫টি গ্রামের কারও সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কেও আবদ্ধ হতে চান না। এতটাই বদনাম রাস্তাটির। এমনকী রাতে ওই রাস্তা দিয়ে মরনাপন্ন মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যও অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকতে চায়না।”

ওই রাস্তার এক ধারে জেলা পরিষদ অনুমোদিত পলেমপুরে টোল কর আদায় অফিসে কাজ করেন মোল্লা জিয়ারুদ্দিন, সমীর ঘোষ ও শেখ লাল। তাঁরা বলেন, “অনুমোদিত খাদানের সংখ্যা কত জানি না। তবে এলাকায় অন্তত অর্ধাশতাধিক বালি খাদান চলছে। গোটা রাস্তায় চারটি টোল পয়েন্ট রয়েছে। দশ চাকা লরি পিছু ১২০ টাকা, ৬ চাকার লরি ১০০ টাকা ও ট্রাক্টর-ট্রলি পিছু ২০ টাকা করে কর দিতে হয়।” তবে বালি খাদান থেকে যে যানগুলি চলাচল করে তাদের অনেকেই কর দেয় না। চাইতে গিয়ে অনেকসময়েই মাফিয়াদের মারধরের মুখে পড়তে হয় বলেও তাঁদের অভিযোগ।

তবে ট্রাকে কতটা বালি রয়েছে তা মাপার কোনও জায়গা এই টোলকর আদায় অফিসে। কর্মীরা বলেন, “যথেচ্ছ ওভারলোডিং করে ট্রাক আসাযাওয়া করলেও আমরা তা মাপতে পারি না। সেটা করার কথা পুলিশ বা ভূমি সংস্কার দফতরের।” তবে সেই দফতরের কাউকে অবশ্য কোনদিনই ওই রাস্তায় বালিবোঝাই ট্রাক আটকে ওভারলোডিং ঠেকাতে দেখা যায় না বলেও স্থানীয়দের দাবি।

জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার অধিকর্তা অশোক সাহা অবশ্য এই অভিযোগ মানতে চাননি। তিনি বলেন, “গোটা জেলা জুড়েই আমরা বালির ট্রাক আটকে ওভারলোডিং পরীক্ষা করি। জরিমানাও করা হয়। মাঝেমধ্যে চালককে গ্রেফতারও করা হয়। তবে খণ্ডঘোষের দামোদর নদের বাঁধের উপরের ওই রাস্তা বা বড়শূলের রাস্তার পাশে অবস্থিত অনেক বালি খাদান সরকার অনুমোদিত কি না তা নিয়ে আমাদেরও সন্দেহ রয়েছে। মাঝেমধ্যে খাদান দখল নিয়ে মাফিয়াদের মধ্যে মারপিটের খবর পাই। তাতে গোলাগুলিও চলে।”

আর রাস্তা সারানো? জেলা পরিষদের সভাধিপতি দেবু টুডু বলেন, “আগে মাত্র ৭০ লক্ষ টাকা টোল কর বাবদ জেলা পরিষদ পেত। এ বার তা বেড়ে দাড়িঁয়েছে ১ লক্ষ ৭১ হাজারে। ওই রাস্তা নিয়ে প্রায়ই স্থানীয় মানুষ আমার কাছে অভিযোগ করেন। রাস্তাটির অবস্থাও সত্যিই বেহাল। তবে ওই রাস্তা সারানোর টেন্ডার ডাকা হয়েছে। শীঘ্রই কাজ শুরু হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sand rana sengupta khandagosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE