Advertisement
২০ মে ২০২৪

রোহনকে বাঁচাতে তাঁত বন্ধ রেখে একজোট গ্রাম

রোজই সকাল-সন্ধ্যা গ্রামের যে কোনও বাড়ির দরজায় কান পাতলেই শোনা যায়খটাখট, খটাখট। কিন্তু বৃহস্পতিবার সব চুপচাপ। সবাই যে যার তাঁত বন্ধ করে ভিড় করেছেন গ্রামের এক কোণে অস্থায়ী তাঁবুটিতে। ঘরের ছেলেটার যে প্রাণসঙ্কট।

হাটশিমলা গ্রামে রোহনের জন্য রক্তদান শিবির। —নিজস্ব চিত্র।

হাটশিমলা গ্রামে রোহনের জন্য রক্তদান শিবির। —নিজস্ব চিত্র।

কেদারনাথ ভট্টাচার্য
পূর্বস্থলী শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৪ ০০:৫৭
Share: Save:

রোজই সকাল-সন্ধ্যা গ্রামের যে কোনও বাড়ির দরজায় কান পাতলেই শোনা যায়খটাখট, খটাখট। কিন্তু বৃহস্পতিবার সব চুপচাপ। সবাই যে যার তাঁত বন্ধ করে ভিড় করেছেন গ্রামের এক কোণে অস্থায়ী তাঁবুটিতে। ঘরের ছেলেটার যে প্রাণসঙ্কট।

পূর্বস্থলীর নসরৎপুর পঞ্চায়েতের হাটশিমলা গ্রামের সাড়ে তিন বছরের রোহন বেশ কয়েক মাস ধরেই ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত। বাবা তাঁত চালিয়ে আর মা-ঠাকুমা সুতো কেটে যে রোজগার করেন, তাতে সংসারের এক দিক ঢাকতে আরেক দিক বেরিয়ে পড়ে। তার মধ্যেও আদর-যত্নে বড় হচ্ছিল রোহন। কিন্তু কয়েক মাস আগে থেকেই ঘন ঘন জ্বরে ভুগতে থাকে সে। কালনা, কৃষ্ণনগর নানা জায়গায় চিকিৎসা করানোর পরেও বিশেষ লাভ হয়নি। পরে চন্দননগরের এক চিকিৎসক জানান, রোহন ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত। মাথায় বাজ পড়ে বাড়ির লোকেদের। নৈহাটি ও কলকাতায় একাধিক পরীক্ষা করার পরে সপ্তাহ দুয়েক ধরে কলকাতার নীলরতন হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তার। বুধবার হাসপাতালে ভর্তিও করা হয়েছে তাকে।

এ দিন ছেলে-বৌমার সঙ্গে নাতিকে কলকাতায় পাঠিয়ে মাটি-দরমার ঘর আগলে বসেছিলেন ঠাকুমা ছায়া দাস। আশপাশের কেউ খোঁজ নিতে এলেই বের করে দেখাচ্ছিলেন নাতির নানা সময়ের ছবি। জিজ্ঞেস করায় বললেন, “বাড়ির পাশের ছোট মাঠটা ওর খুব পছন্দের। সারাদিন বল নিয়ে ওখানেই পড়ে থাকত।”

গ্রামবাসীরাই জানালেন, রোহনকে সারিয়ে তুলতে ধাপে ধাপে প্রায় ৫০ বোতল রক্ত দরকার। আর দরকার কয়েক লক্ষ টাকাও। এ দিন তাই পলিথিনের শেড দেওয়া তাঁবুর বাইরে ভিড় করে রক্ত দিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন গ্রামের হাজার দু’য়েক বাসিন্দাদের বেশিরভাগই। কেউ কেউ ভিতরে রক্ত দেওয়া-নেওয়ার কাজে সাহায্যও করেছেন, আবার কেউ মাইক ফুঁকে পথচলতি লোকজনের কাছেও সাহায্য চেয়েছেন। অনেকে আবার প্ল্যকার্ড লিখে, ফেস্টুন টাঙিয়েও সাহায্য চেয়েছেন। গ্রামবাসীদের এমন উদ্যোগ দেখে ছায়াদেবী বলেন, “ওরা অনেকেই আমার ছেলের বন্ধু। গ্রামের মেয়েরাও দুর্দিনে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ভাবতে পারিনি এমনও হতে পারে।”

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামলেও ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল। ছেলে-যুবকেরা তো বটেই মেয়ে-বউরাও ঘরের কাজ শেষ করে দলবেঁধে রক্ত দিতে আসছিলেন। অনেকে আবার জামাইষষ্ঠীতে বেড়াতে এসেও পোস্টার দেখে রক্ত দিয়ে গেলেন। এমনই একজন নবদ্বীপের ঝর্ণা কুণ্ডু বলেন, “বেড়াতে এসে শুনলাম গ্রামের এক শিশুকে বাঁচাতে রক্ত দরকার। শোনার পরেই নিজের আড়াই বছরের ছেলের মুখটা ভেসে উঠল। এরপর আর অন্য কিছু ভাবিনি।” শিবিরে হাজির সজল বসাক, শ্যামল চৌধুরী, রবীন্দ্র বসাকেরাও বলেন, “সবাই তাঁত বুনে জীবন চালাই। কিন্তু ডাক্তার রোহনের জন্য ৫০-৬০ বোতল রক্ত চেয়েছেন শোনার পরে গোটা গ্রাম প্রতিজ্ঞা করেছে রক্ত দেওয়ার। সন্ধ্যা পর্যন্ত রক্তদাতাদের যত কার্ড হবে সবটাই দেওয়া হবে রোহনের পরিবারের হাতে।” চিকিৎসায় অর্থ সাহায্য করতেও এগিয়ে এসেছেন বহু মানুষ। তবে যে হাজার পাঁচেক টাকা উঠেছে তা প্রয়োজনের তুলনায় বড়ই কম। শিবিরে ছিলেন নসরৎপুরের প্রাক্তন প্রধান চন্দনা বসাকও। তিনি বলেন, “রোহনের জন্য আমরা অনেক দূর যাব। ইতিমধ্যেই অনেকের কাছে টাকার জন্য আবেদন করেছি। আশা করি আশপাশের গ্রামেরও মানুষও এগিয়ে আসবেন।”

দূরে লাইন দেখে ছায়াদেবী বলে ওঠেন, “ওদের ভরসাতেই তো রোহনের আবার বল নিয়ে দৌড়নোর স্বপ্ন দেখছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kedarnath bhattacharya purbasthali rohan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE