Advertisement
১৮ মে ২০২৪
আজ শিক্ষক দিবস

স্কুলছুট ছাত্রদের দরজায় টোকা প্রধান শিক্ষকের

হঠাৎ তাঁকে দেখলে মনে হবে বিগত শতাব্দীর ‘টু স্যার, উইথ লাভ’ সিনেমার থ্যাকারে স্যার। থ্যাকারে সাহেবের মতো বর্ধমানের বড় নীলপুরের এই স্যারেরও দেখা মেলে স্কুলছুট ছাত্রের বাড়ির দরজায় বা পড়ুয়াদের সাথে খেলার মাঠে। তিনি আচার্য দুর্গাপ্রসন্ন বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক সুজিতকুমার চৌধুরী। তাঁর স্কুল থেকে পড়ুয়াদের পালানোর উপায় নেই। কারণ কেউ স্কুল ছাড়লেই সুজিতস্যার সটান পৌঁছে যান পড়ুয়ার বাড়ি। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে পড়ুয়াটিকে ফিরিয়ে আনেন ক্লাসঘরে।

সুজিত চৌধুরী। —নিজস্ব চিত্র।

সুজিত চৌধুরী। —নিজস্ব চিত্র।

রানা সেনগুপ্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:১৬
Share: Save:

হঠাৎ তাঁকে দেখলে মনে হবে বিগত শতাব্দীর ‘টু স্যার, উইথ লাভ’ সিনেমার থ্যাকারে স্যার।

থ্যাকারে সাহেবের মতো বর্ধমানের বড় নীলপুরের এই স্যারেরও দেখা মেলে স্কুলছুট ছাত্রের বাড়ির দরজায় বা পড়ুয়াদের সাথে খেলার মাঠে।

তিনি আচার্য দুর্গাপ্রসন্ন বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক সুজিতকুমার চৌধুরী। তাঁর স্কুল থেকে পড়ুয়াদের পালানোর উপায় নেই। কারণ কেউ স্কুল ছাড়লেই সুজিতস্যার সটান পৌঁছে যান পড়ুয়ার বাড়ি। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে পড়ুয়াটিকে ফিরিয়ে আনেন ক্লাসঘরে। আঠান্ন বছরের সুজিতবাবুকে শিক্ষক দিবসের দিন নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দেওয়া হবে শিক্ষারত্ন পুরষ্কার।

স্কুলছুটের হার কমাতে জেলা স্তরে রয়েছেন একজন নোডাল অফিসার পল্লব পুরকায়েত। সুজিতবাবু থাকায় নিশ্চিন্ত পল্লববাবু। তিনি বলেন “দুর্গাপ্রসন্ন বিদ্যামন্দির নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। কারণ কেউ স্কুলছুট হলেই প্রধানশিক্ষক নিজেই দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেন। উনিই ওই স্কুলে শতকরা ৯৫ ভাগ ড্রপআউট কমিয়ে ফেলেছেন। তা ছাড়া কন্যাশ্রী প্রকল্পেও ওই স্কুল ১০০ শতাংশ সফল।”

সুজিতবাবু জানান, স্কুলের বেশিরভাগ পড়ুয়াই আসেন অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবার থেকে। তাই ক্লাস এইটে ওঠার আগেই অনেকে স্কুল থেকে পালায়। শিক্ষা দফতর থেকে নিয়োগ করা স্কুলের দু’জন এডুকেশন ভলেন্টিয়ার নজর রাখেন কোন কোন পড়ুয়ারা নিয়মিত কামাই করছে কি না। সেই রিপোর্ট হাতে পেলেই অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে সুজিতবাবু শুরু করেন পড়ুয়াটিকে স্কুলে ফেরানোর কাজ।

স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা গেল স্কুলে দপ্তরির দেখা না মিললে ছুটির ঘন্টাও নিজেই বাজাতেন সুজিতবাবু। ক্লাসঘর অপরিষ্কার দেখলে হাত লাগান সাফাই অভিযানেও।

স্কুলের মাঠ নেই। সুযোগ পেলেই স্থানীয় সর্বমিলন সঙ্ঘের মাঠে ছাত্রদের সঙ্গে মেতে ওঠেন ভলিবল বা অ্যাথলিটিকে। স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের সুজিতবাবু বলেন, “মাঠ নেই বলে কী আমি নিজে যে খেলাগুলো খেলতাম সেগুলো ছাত্রদের শেখাবো না?” তবে শুধু কোচ হিসেবেই নয়, স্কুলের ছাত্র অনুপ হাজরা, পার্থ দাসরা জানান, এবারেও স্কুল স্পোর্টসে সুজিত স্যার বছর চব্বিশের খেলার শিক্ষকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন। শিক্ষকদের জেলা মিটে রাজ্য স্তরেও জিতেছেন বহু পদক। স্থানীয় যুবক বিশ্বনাথ দেবনাথ বলেন, “সুজিতবাবু সারাদিন ছেলেমেয়েদের নিয়ে পড়ে রয়েছেন। পড়ুয়াদের সঙ্গে তিনি বন্ধুর মত মেশেন।”

১৪ নম্বর ওয়ার্ডের পুর প্রতিনিধি গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “গুরুদেবের মত এমন একটা পিছিয়ে পড়া স্কুলকে ধরে রেখেছেন তিনি।”

সুজিতবাবুকে শিক্ষারত্ন দেওয়া হলেও সরকার এখনও স্কুলের কম্পিউটার কেনার টাকা দেয়নি। নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। এবারেও পথ দেখালেন সুজিতবাবু। স্কুলের ফান্ডের টাকায় কেনা হল কম্পিউটার।নিয়োগ করা হল আংশিক সময়ের শিক্ষক।

স্কুলের একটি মাত্র সিঁড়ি দিয়ে ছেলে-মেয়েরা নামত। আপত্তি জানাতেন অভিভাবকেরা। ২০০৫-এ স্কুলের দায়িত্ব নিয়ে সুজিতবাবুর উদ্যোগেই দুটি আলাদা সিঁড়ি তৈরি হল। স্কুলে এখন ৫টি পরীক্ষাগার, ২৮টি ঘর।

কেমন লাগছে শিক্ষারত্ন পুরষ্কারের খবর পেয়ে? উত্তরে সুজিতবাবু বললেন, “কাজের একটা স্বীকৃতি পেলাম। ইচ্ছে আছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে স্কুলের শতকরা একশোভাগ পড়ুয়া পাশ করেছে, সেটা দেখে যাওয়া।”

সুজিতবাবুর ছাত্ররাও ‘ডেড পয়েটস্ সোসাইটি’র ছাত্রদের মত প্রিয় স্যারকে নেতাজী ইন্ডোরে যাওয়ার আগে বলছেন ‘ও কাপ্তেন, ডিয়ার কাপ্তেন!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE