Advertisement
১৮ মে ২০২৪

হস্টেলে নির্যাতনের নালিশ, স্কুল ছাড়ল ছাত্র

বড় বালতিতে জল আনা থেকে বাসন মাজা, উঁচু ক্লাসের আবাসিকদের নির্দেশে করতে হত সব কিছুই। রাতে লাঠি দিয়ে মারধর। দুর্গাপুরে অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু আবাসিক স্কুলের হস্টেলে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রের উপরে প্রায়শয়ই এমন অত্যাচার চালানো হত বলে অভিযোগ তার বাবা-মায়ের। পুরুলিয়ার পুঞ্চার বাসিন্দা ওই ছাত্রটিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তাঁর বাবা-মা। তাঁদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষককে ঘটনা জানানো হলেও তিনি কোনও ব্যবস্থা নেননি।

সমীর দত্ত ও সুব্রত সীট
পুঞ্চা ও দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৪ ০০:৫২
Share: Save:

বড় বালতিতে জল আনা থেকে বাসন মাজা, উঁচু ক্লাসের আবাসিকদের নির্দেশে করতে হত সব কিছুই। রাতে লাঠি দিয়ে মারধর। দুর্গাপুরে অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু আবাসিক স্কুলের হস্টেলে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রের উপরে প্রায়শয়ই এমন অত্যাচার চালানো হত বলে অভিযোগ তার বাবা-মায়ের।

পুরুলিয়ার পুঞ্চার বাসিন্দা ওই ছাত্রটিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তাঁর বাবা-মা। তাঁদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষককে ঘটনা জানানো হলেও তিনি কোনও ব্যবস্থা নেননি। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ও পুরুলিয়ার পুলিশ সুপারকে চিঠি লিখে বিষয়টি জানিয়েছেন তাঁরা। হস্টেলের এই অভিজ্ঞতায় বছর দশেকের ছেলেটি এখন এতটাই আতঙ্কিত যে আর কোনও স্কুলে সে ভর্তি হতে চাইছে না, জানান তার বাবা-মা। স্কুল কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করেছেন তাঁরা। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার বলেন, “ঘটনাটি শুনেছি। অভিযোগপত্র এখনও হাতে পাইনি। পেলে গুরুত্ব দিয়ে দেখব।”

পুঞ্চার জলহরি গ্রামে চাষাবাদ করে সংসার চালান ছেলেটির বাবা। তিনি জানান, অভাবের সংসার। তাই ছেলেকে নিখরচায় পড়াশোনা করাতে গত ২০ জানুয়ারি ভর্তি করেন দুর্গাপুরের ওই স্কুলে। তিনি বলেন, “১৩ মার্চ ছেলে ফোন করে জানায়, ওখানে আর পড়বে না, বাড়ি ফিরতে চায়। ওর গলা শুনে আমাদের সন্দেহ হলেও ও আর কিছু বলতে চায়নি। ১৫ তারিখ আমি স্কুলে যাই। তখনও জানায়, বাড়ি যেতে চায়। ভেবেছিলাম, মন খারাপ হয়েছে। তাই ১৬ তারিখ ছেলেকে বাড়ি নিয়ে আসি।”

ছাত্রটির মা জানান, বাড়ি ফিরে স্নান করার সময় ছেলে কিছুতেই জামা খুলতে চাইছিল না। জোর করে জামা খুলে তাঁরা দেখেন, গোটা পিঠ লাল হয়ে রয়েছে। তখন চেপে ধরতেই ছেলে সব খুলে বলে। বাবার অভিযোগ, “হস্টেলে একটি ঘরে আরও সাত জনের সঙ্গে থাকত আমার ছেলে। বেশির ভাগই সপ্তম শ্রেণির। তারা ওকে দিয়ে বড় বালতিতে করে স্নানের জল আনাত। ঘর ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজার কাজও করাত। রোজ রাতে খাওয়ার পরে ওকে লাঠি দিয়ে পেটাত। কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকিও দিত। তাই ভয়ে আমাদের কিছু জানায়নি।”

ওই ছাত্রের বাবা জানান, ছেলেকে তাঁরা মানবাজারে এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসায় পিঠের ব্যথা ও দাগ সারলেও ছেলে আর স্কুলে যেতে চাইছে না। তাঁর দাবি, স্কুলে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করে লিখিত অভিযোগ করেন তাঁরা। ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবিও জানান। কিন্তু প্রধান শিক্ষক বিশুদ্ধানন্দ রায় তাতে কর্ণপাত করেননি বলে তাঁর অভিযোগ। পরে ছেলের ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে ফিরে আসেন তাঁরা।

প্রধান শিক্ষক গোটা ঘটনা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। ওই হস্টেলের সুপার তুষারকান্তি গুলুইয়ের দাবি, “এমন কোনও ঘটনা আমার জানা নেই। কেউ আমার কাছে কোনও অভিযোগ জানায়নি।” তবে হস্টেলের এক কর্মী বলেন, “দিন কয়েক আগে পঞ্চম শ্রেণির এক পড়ুয়া রাতে বিছানায় প্রস্রাব করে ফেলে। তখন তাকে ষষ্ঠ শ্রেণির দু’জন ও সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্র মারধর করে।” তিনি জানান, পর দিন ওই ছাত্রদের বকাঝকা করা হয়। বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানানো হয়।

স্কুল পরিচালন সমিতির সম্পাদক কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও মেনে নেন, ওই ছাত্র মারধরের অভিযোগ করেছিল। তার পিঠে চোটের চিহ্নও ছিল। কল্যাণবাবুর দাবি, “ঘটনায় জড়িত তিন ছাত্রের বাবা-মাকে ডেকে সব জানানো হয়। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রটির বাড়ির লোকজনকে জানিয়েছিলাম, আর এমন ঘটবে না। তবু ওঁরা দাবি করেন, অভিযুক্ত তিন ছাত্রকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। তবেই তাঁরা ছেলেকে এখানে রাখবেন। কিন্তু অভিযুক্তদেরও বয়স কম। স্কুল থেকে বের করে দিলে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। তাই ওই দাবি মানা সম্ভব হয়নি।”

কল্যাণবাবু যদিও ঘটনাটি র্যাগিং বলতে নারাজ। তিনি বলেন, “ওই পড়ুয়ারা একেবারেই ছোট। ওরা এখনও ও সব বোঝে না।” স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই তিন পড়ুয়াকে দু’সপ্তাহের জন্য বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গোটা ঘটনার পরে পুঞ্চার বাড়িতে জড়োসড় হয়ে রয়েছে ছেলেটি। কী হয়েছে জানতে চাওয়া হলে সে শুধু বলে, “আমি আর ওই স্কুলে যাব না।” অন্য স্কুলে যাবে তো, প্রশ্ন শুনে মাথা নিচু করে ফেলে সে। উত্তর মেলে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE