Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

অভিযাত্রীরা সতর্ক হোন, বলছেন দেবরাজ

শরীর কতটা সইতে পারবে তা নিয়ে অভিযাত্রীরা সর্তক থাকলেই হাজার হাজার ফুট উচ্চতায় তুষার পথে দুর্ঘটনার আশঙ্কা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন এভারেস্ট ছুঁয়ে আসা দেবরাজ দত্ত।

ন্যাফের অনুষ্ঠানে এভারেস্টজয়ী দেবরাজ দত্ত।

ন্যাফের অনুষ্ঠানে এভারেস্টজয়ী দেবরাজ দত্ত।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৬ ০২:৪৩
Share: Save:

শরীর কতটা সইতে পারবে তা নিয়ে অভিযাত্রীরা সর্তক থাকলেই হাজার হাজার ফুট উচ্চতায় তুষার পথে দুর্ঘটনার আশঙ্কা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন এভারেস্ট ছুঁয়ে আসা দেবরাজ দত্ত।

বৃহস্পতিবার বিকেলে শিলিগুড়িতে ফিরেছেন দেবরাজ। শিলিগুড়ির পরিবেশপ্রেমী এবং অভিযাত্রীদের সংগঠন হিমালয়ান নেচার এন্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের তরফে (ন্যাফ) এ দিন বিকেলে দেবরাজকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এভারেস্ট ছুঁয়ে আসা প্রদীপ সাহুকেও এ দিন ন্যাফের দফতরে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

এখানেই অন্তত ত্রিশটি অভিযানের অভিজ্ঞতা থাকা দেবরাজবাবু দাবি করেন, প্রাকৃতিক কোনও বিপর্যয় না হলে একমাত্র অভিযাত্রীর নিজের শারিরীক সক্ষমতা অনুযায়ী পদক্ষেপ এবং সিদ্ধান্ত অভিযানকে নিরাপদ করতে পারে। পাহাড়ি পথে অভিযাত্রীদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কারণে নির্বিচারে শেরপাদের দায়ী করাও বাঞ্ছনীয় নয় বলে এ দিন জানিয়েছেন দেবরাজ।

দেবরাজ, প্রদীপবাবুর সঙ্গে অভিযানে সামিল ছিলেন চেতনা সাহুও। প্রদীপবাবুর স্ত্রী চেতনাদেবী এভারেস্ট জয় করে তুষার ক্ষতে আক্রান্ত হন। শিলিগুড়ির একটি নার্সিংহোমে ভর্তি রয়েছেন তিনি। দেবরাজ এবং প্রদীপবাবু এভারেস্ট শৃঙ্গ ছুঁয়ে সাউথ কোলে পৌঁছে খবর পেয়েছিলেন চেতনাদেবীর শারীরিক সমস্যা হচ্ছে। শেরপাদের কাছে থাকা ওয়াকিটকিতে ভেসে আসছিল চেতনাদেবী দুর্বল হয়ে পড়ছেন, সিলিন্ডারের অক্সিজেনও ফুরিয়ে যাচ্ছিল। সময় চলে গেলে চেতনাদেবীকে সুস্থ ভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা করেই উদ্ধারকারী দলের সাহায্য নিয়ে দুই শেরপাকে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে সাউথ কোল থেকে রওনা করিয়ে দেন দেবরাজবাবু-প্রদীপবাবুরা।

এ দিন দেবরাজবাবু বলেন, ‘‘অভিযাত্রীর শারীরিক সক্ষমতা এবং সিদ্ধান্তই তাঁর রক্ষাকবচ। কারও টানা ২০ ঘণ্টা পাহাড়ি পথে ওঠা-নামার ক্ষমতা নাও থাকতে পারে, সেটা তাঁকে বুঝতে হবে। সেই মতো বিশ্রাম নিতে হবে। তা না করে টানা অভিযান চালিয়ে গেলে বিপদ আসন্ন।’’ এভারেস্ট ছুঁতে যাওয়ার আগে একাধিক কম উচ্চতার শৃঙ্গ জয় করার অভিজ্ঞতা না থাকলে পদে পদে বিপদ হতে পারে। দেবরাজবাবুর কথায়, ‘‘অনেকেই ভাবে একটি বা দু’টি শৃঙ্গ জয় করার পরে, অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে এভারেস্টেও পৌঁছে যাবেন। এমনটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।’’

শেরপাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন এভারেস্ট জয়ী প্রদীপবাবুও। তিনি বলেন, ‘‘আমরা এতদিন ধরে অভিযানে গিয়েছি। শেরপাদের অসহযোগিতা পাইনি। উল্টে এবার শেরপাদের সাহায্যেই আমার স্ত্রীকে নামিয়ে আনতে পেরেছি। তবে পাহাড়ের উঁচুতে কেউ নিখোঁজ হয়ে গেলে শেরপারাও যদি সেখানে থেকে যান তবে অক্সিজেনের অভাবে শেরপারাও মারা যাবেন। তাতে প্রাণহানি বাড়বে।’’

দুই সফল অভিযাত্রীই দাবি করেছেন পর্বত অভিযানের ক্ষেত্রে বিশেষত এভারেস্ট ছুঁতে গেলে অভিযাত্রীদের সব বিধি-নিষেধ কঠোরভাবে মানা উচিত। এভারেস্ট অভিযানে যাওয়ার আগে অভিযাত্রীদের নিজেদের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কোনও অভিযাত্রী সঠিক তথ্য দিচ্ছেন কিনা তা যাচাই করার কোনও নজরদারিও নেই বলে অভিযোগ।

বেহালার বাসিন্দা দেবরাজ ন্যাফের সদস্য। ন্যাফের মুখপাত্র অনিমেষ বসু এ দিন বলেন, ‘‘সংবর্ধনা বলতে যা বোঝায় তেমন কোনও অনুষ্ঠান হয়নি। অভিযাত্রীদের মধ্যে অনেকেই এখনও নিখোঁজ। সকলেরই মন-মেজাজ ভাল নয়। তাই শুধু ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। পরে বড় আকারে সংবর্ধনা হবে। আপাতত চাইছি পর্বত অভিযানে যেন দুর্ঘটনার প্রবণতা কমে।’’

এ দিকে শিলিগুড়ি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এভারেস্ট জয়ী চেতনা সাহুর চিকিৎসায় সাড়া মিলছে বলে দাবি করেছেন চিকিৎসকরা। শয্যার পাশে চেয়ারে বসেছিলেন চেতনা। চিকিৎসক জানান, তাঁর দুই হাতের আঙুলের মাথাগুলি কালো হয়ে গিয়েছে তুষার ক্ষতে। তাতে কী। চেতনা সাহু বলেন, ‘‘এভারেস্টে উঠতে পেরেছি এটা ভেবেই দারুণ লাগছে। অনেক চেষ্টার পর। সেই অভিজ্ঞতা ভোলার নয়।’’ মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। আবার মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। পাহাড়ের আবহাওয়ার মতোই তার মুখের ভাব বদলে যায় নামার সময় বিপদে পড়ার সেই অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে।

১৯ মে এভারেস্ট জয়ের পর ফেরার পথে দলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সঙ্গী স্বামী প্রদীপ সাহু এবং দেবরাজ দত্তরা ক্যাম্প ফোরে নেমে পড়েছেন। তিনি ধীরে হাঁটছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকার নেমে এসেছিল পাহাড়ের বুকে। তাঁর শরীর অবসন্ন হয়ে পড়ে। চেতনা দেবী বলেন, ‘‘তখন অক্সিজেন ফুরিয়ে এসেছিল। পা চলছিল না। কিন্তু ফিরতে হবে। আমাকে নামতেই হবে। এই ইচ্ছেটাই কেবল ছিল।’’

প্রদীপবাবু উদ্ধারকারী দলের ওই দুই শেরপাকে দিয়ে অক্সিজেন পাঠান। পরে প্রদীপবাবু গিয়ে তিন জনে মিলে চেতনা দেবীকে উদ্ধার করে রাত দু’টো নাগাদ ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হন। তখন চলতে পারছিলেন না তিনি। সেই দৃশ্যগুলিই এখনও চেতনাদেবীর চোখে ভেসে উঠছে নার্সিংহোমে বসে।

নার্সিংহোমে তাঁর চিকিৎসার জন্য গুয়াহাটি থেকে এসেছিলেন প্লাস্টিক সার্জারির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পঙ্কজ ভরদ্বাজ। প্রয়োজনে ফের তিনি আসবেন। প্রদীপবাবু জানান, দিল্লিতে সেনা বাহিনীর চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করছেন। আরও কয়েকদিন এখানে কাটিয়ে চেতনা দেবী সুস্থ হয়ে উঠলে তাঁকে দিল্লিতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন প্রদীপবাবু।

ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE