Advertisement
E-Paper

অতিথি হাঁসের ভিড়ে একা-একলা ভবঘুরে

পাকেচক্রে এ দেশে এসে পড়ে সাগরপারের এক বিদেশি কী ভাবে সাধারণ সংসারে সুখেদুঃখে কিছু দিন কাটিয়েছিলেন, ‘ভিখারি সাহেব’ গল্পে তার শিল্পিত বিবরণ দিয়েছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩১

পাকেচক্রে এ দেশে এসে পড়ে সাগরপারের এক বিদেশি কী ভাবে সাধারণ সংসারে সুখেদুঃখে কিছু দিন কাটিয়েছিলেন, ‘ভিখারি সাহেব’ গল্পে তার শিল্পিত বিবরণ দিয়েছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। ‘অতিথি দেবো ভব’র দেশে কোনও কালেই মনুষ্য এবং মনুষ্যেতর অতিথি-আগন্তুকের অভাব হয়নি। যেমন এ বার দার্জিলিঙের গজলডোবায় এসে কৌতূহলীদের নজর কেড়েছে আদতে সাইবেরিয়া-জাত এক হংসপক্ষী।

গজল়ডোবার পরিযায়ী পাখির আস্তানায় নতুন আসা এক প্রজাতির পাখি দেখতে গিয়েছিলেন অমিতাভ বসু। চোখে দেখার সুযোগ হলেও তাদের ক্যামেরাবন্দি করতে পারেননি তিনি। আশেপাশে নানা ধরনের হাঁসের ঝাঁকের ছবি তুলেই ফিরে এসেছিলেন ওই পক্ষিপ্রেমী। বাড়ি ফিরে সেই সব ছবি খুঁটিয়ে দেখতে গিয়েই খোঁজ পেয়ে যান অন্য এক নতুন অতিথির! নাম তার ‘বিন গুজ’।

পক্ষিপ্রেমীরা বলছেন, শীতপ্রধান এলাকা থেকে এ রাজ্যে বেড়াতে আসা পাখিদের মধ্যে এর আগে বিন গুজ দেখা যায়নি কোনও দিন। এবং সামনের বছরও তাকে দেখা যাবে কি না, তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে পক্ষিবিশারদদের। কারণ, ফি-বছরের শীতে যে-সব পাখি এ দেশে আসে, তাদের তালিকায় পড়ে না বিন গুজ। বরং এমন অতিথিকে ‘ভবঘুরে’ বলেই চিহ্নিত করছেন বিজ্ঞানীরা।

পক্ষিবিশারদেরা জানাচ্ছেন, বিন গুজ সাধারণ ভাবে ভারতের পথ মাড়ায় না। কখনও-সখনও রাস্তা ভুল করে তাদের দু’-এক জন অন্য প্রজাতির হংসসারির মধ্যে ঢুকে পড়ে। সেই দলের সঙ্গে কোনও ভাবে কয়েকটা দিন কাটিয়ে ফিরে যায় আপন ঘরে। আকারে-চেহারায় মিল থাকায় পরিযায়ী হাঁসের কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে তাকে গুলিয়ে ফেলা সহজ। কিন্তু পক্ষিপ্রেমীদের ডায়েরি জানাচ্ছে, কখনওই সে এ দেশের নিয়মিত অতিথি ছিল না। কালেভদ্রে যখনই তার দেখা মিলেছে, সব সময়েই সে মিশে থেকেছে পরিযায়ী হাঁসের ভিড়ে। ফলে এ রাজ্যের নিরিখে বিন গুজ বেশ বিরল।

এ বার পরিযায়ী হাঁসেদের ছবি তুলতে গিয়েই তো বিন গুজ দেখে ফেলেছেন অমিতাভবাবু! তিনি বলছেন, ‘‘গজল়ডোবায় ব্রাহ্মণী হাঁসের ঝাঁকের মধ্যে একটি মাত্র বিন গুজের (হাঁস) দেখা মিলেছে।’’

এ রাজ্যে নতুন হলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কয়েক বার দেখা মিলেছে বিন গুজের। কখনও রাজস্থানের বিকানের কিংবা সরিস্কায়, কখনও অসমে, কখনও বা পঞ্জাবে। গত বছর সরিস্কায় দেখা গিয়েছিল তাকে। পক্ষিপ্রেমীরা বলছেন, চেহারায় মিল থাকায় কখনও কখনও ‘গ্রে ল্যাগ গুজ’ বা অন্য পাখির সঙ্গে মিশে যায় বিন গুজ। যত দূর জানা গিয়েছে, বিকানেরে এই প্রজাতির পাখির প্রথম দেখা মিলেছিল ১৯৪৮ সালে। তবে পক্ষিবিশেষেজ্ঞ হুমায়ুন আবদুলালি পরবর্তী কালে দাবি করেন, সেটি মোটেই বিন গুজ ছিল না। আর অসমে এই পাখিই দেখা গিয়েছিল কি না, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম অধিকর্তা সুজিত চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, তাঁদের রেকর্ডে অসমের উল্লেখ আছে। কিন্তু এ রাজ্যের কোথাও এই পাখি আগে দেখা যায়নি। ২০০৩ সালে পঞ্জাবে বিপাশা নদীর তীরে এই প্রজাতির একটি পাখিকে ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন পক্ষিপ্রেমী সুজন চট্টোপাধ্যায়। তিনিও বলছেন, ‘‘এ রাজ্যে বিন গুজ আগে দেখা যায়নি।’’

বিন গুজের একটি বিচিত্র বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছেন পক্ষিবিশারদেরা। বিকানের, সরিস্কা, অসম, পঞ্জাব— সর্বত্রই বিন গুজ প্রজাতির একটি করে পাখিই দেখা গিয়েছে। কখনওই ঝাঁক বেঁধে এ দেশে আসেনি ওরা। সেই সূত্রেই ভবঘুরে তকমা জুটেছে বিন গুজের। তবে এই একাচোরা ব্যাপারটা সত্যিই তাদের প্রজাতিগত স্বভাব, নাকি এর পিছনে অন্য কোনও কারণ আছে, তার নিঃসংশয় মীমাংসা এখনও হয়নি। সুজিতবাবুর ব্যাখ্যা, পরিযায়ী পাখিদের নির্দিষ্ট একটি পথ থাকে। সেই রাস্তা ধরেই ওরা আসে এবং ফিরে যায়। কিন্তু বিন গুজের এ দেশে আসার তো কথাই নয়। পথ ভুলে ভবঘুরের মতো এখানে ঢুকে পড়ে ওরা। একই সুর সুজনবাবুর গলাতেও। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক সময়েই ভুল করে পরিযায়ী হাঁসের দলে ভিড়ে যায় দু’-একটি বিন গুজ। পথ হারিয়ে তাদের সঙ্গেই পাড়ি জমায় এ দেশের নানা জায়গায়। সেই জন্যই তাদের ঝাঁক চোখে পড়ে না।’’

দার্জিলিং থেকে এ বারের পাখিটি ফিরে গেলে সে বা তার গোষ্ঠীর অন্য কেউ গজলডোবা কিংবা এ রাজ্যের অন্য কোনও জায়গায় আবার কবে হাজির হবে, আদৌ হবে কি না— তার উত্তর জানে শুধু ভবিষ্যৎ।

Bean Goose Migratory Birds
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy