দূষণের নিরিখে দিল্লি দেশের মধ্যে প্রথম। তবে খুব বেশি পিছিয়েও নেই কলকাতা এবং তার দোসর হাওড়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) কিংবা দেশের পরিবেশ নিয়ে গবেষণারত দেশের একাধিক সংস্থা বলছে, বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার নিরিখে কলকাতায় বায়ুও যারপরনাই দূষিত। তার ফলে মহানগরের মানুষও শ্বাসনালি বা ফুসফুসের ক্যানসার, হাঁপানির মতো রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
বায়ু দূষণ ঠেকাতে দিল্লির রাজ্য সরকার পদক্ষেপ করা শুরু করেছে। কিন্তু এ রাজ্যের এখনও টনক নড়েনি। অথচ কলকাতা এবং তার লাগোয়া এলাকাতেই ছড়িয়ে রয়েছে দূষণের একাধিক উৎস। সেগুলি কী? কী ভাবেই বা লাগাম টানা সম্ভব?
গাড়ির দূষণ
পরিবেশকর্মী এবং রাজ্য পরিবেশ দফতরের কর্তারাই বলছেন, এ শহরের দূষণের সব থেকে বড় উৎস গাড়ি থেকে হওয়া দূষণ। কারণ, ডিজেলের মতো জ্বালানি পুড়ে কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো দূষিত হাওয়া বেরোয়। তার উপরে গাড়ির ইঞ্জিন পুরনো হলে কিংবা রক্ষণাবেক্ষণ ঠিক মতো না হলে সেই দূষণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। কলকাতায় বায়ু দূষণ ঠেকাতে ১৫ বছরের বেশি পুরনো গাড়ি বাতিল করতে নির্দেশ দিয়েছিল। বাধ্যকতামূলক করা হয়েছিল গাড়ির পরিবেশগত ছাড়পত্র।
বাস্তব চিত্রটা বলছে, কলকাতায় ইউরো-৪ ইঞ্জিন চালু হলেও জেলাগুলির ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। ফলে জেলার গাড়ি শহরে ঢুকলে তা দূষণ ছড়ায়। খোদ কলকাতা পুলিশের গাড়ি-ই জেলা থেকে রেজিস্ট্রেশন করে আনা হয়েছে। গাড়ির পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়ার কেন্দ্রগুলি পর্যাপ্ত নয়। তার উপরে ছাড়পত্র কতটা বৈধ ভাবে দেওয়া হয়, তা নিয়েও ধন্দ রয়েছে। পুলিশ ও পরিবেশ দফতরের একাংশ বলছেন, জেলা কিংবা ভিন রাজ্য থেকে যত লরি শহরে ঢোকে, দূষণের পিছনে তারও অবদান কম নয়। এক সময় ডানলপের মতো শহরে ঢোকার পথে দূষিত ও পরিবেশ ছাড়পত্রহীন ট্রাক ধরার অভিযান চালাত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সেই অভিযানও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
কংক্রিটের দূষণ
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক শীর্ষ কর্তা বলছেন, শহরের মধ্যে বিভিন্ন নির্মাণস্থল থেকে ধূলোবালি উড়ে বাতাসে মেলে। তার ফলে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ বাড়ে। সেই সব ধূলিকণা শ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে ঢোকার ফলে নানা ধরনের জটিল রোগ তৈরি করে। রাজ্যের এক পরিবেশ-কর্তা বলছেন, শুধু নির্মাণস্থল নয়, বিভিন্ন নির্মাণস্থলের সামনে রাস্তার উপরে যে ভাবে নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা হয়, তা থেকেও বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ বাড়ে।
দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কর্তারা বলছেন, নির্মাণস্থলের ক্ষেত্রে চারদিক ঢাকা দিয়ে রাখাটাই নিয়ম। নির্মাণসামগ্রীও ঢাকা দিয়ে রাখা উচিত। এই মর্মে পুরসভাকেও বারবার জানানো হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই সব বিধির তোয়াক্কা না করেই নির্মাণকাজ চলছে। খোদ প্রশাসনের কাজেই এ সব নিয়ম মানা হয় না। এক পরিবেশবিদ বলছেন, যশোর রোড চওড়া করার কাজ চলছে। সেখানে এই দূষণের ফলে রাতে চার দিক ঝাপসা হয়ে যায়। পথেঘাটে চলতে গেলে হাঁচি, কাশির মতো উপসর্গ দেখা দিচ্ছে।
রাস্তার ধোঁয়া
খাস শহরের মধ্যে না হলেও শহরের লাগোয়া বিভিন্ন জায়গায় খোলা জায়গায় বর্জ্য পোড়ানো হয়। তার ফলে কার্বন মনোক্সাইড-সহ নানা বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে মেশে। কোথাও কোথাও প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বাতাস আরও বিষাক্ত হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, রাস্তা মেরামতির কাজ করার জন্য প্রকাশ্যে পিচ গলানো হয়। সেখান থেকে গলগল করে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে বাতাসে মেশে। এক পরিবেশকর্মী বলছেন, ‘‘ওই ধোঁয়ায় কার্বন মনোক্সাইড এবং পোড়া কার্বন কণা থাকে। সেগুলি মানুষের শরীরের পক্ষে মারাত্মক।’’ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কর্তারা বলছেন, এ নিয়েও বারবার সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি।
দাওয়াই কী?
রাজ্য পরিবেশ দফতরের কর্তারা বলছেন, দিল্লি দূষণ কমাতে প্রথমেই গাড়ির দূষণে কোপ দিয়েছে। এ শহরেও সেটাই করতে হবে। প্রত্যেকটি গাড়ি যাতে নির্দিষ্ট পরীক্ষা পেরিয়ে পরিবেশগত ছাড়পত্র পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। পুরনো গাড়ি নির্দিষ্ট সময় অন্তর বাতিল করতে হবে। সরকারি সংস্থার গাড়িগুলি যাতে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হয়, সে দিকে নজর রাখতে হবে। রাজ্যের পরিবেশকর্তারা বলছেন, ১৫ বছরের পুরনো গাড়ি যখন বাতিল করা শুরু হয়েছিল এবং অটোয় এলপিজি করা হয়েছিল, তখন দূষণে রাশ টানা গিয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি বাতিল হওয়া বন্ধ হওয়াতে ফের দূষণ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
পরিবেশবিদদের অনেকে বলছেন, কলকাতা এবং জেলার ক্ষেত্রে ইঞ্জিনের মানে যে অসাম্য রয়েছে, সেটাও দূর করতে হবে। তা না হলে দূষণে লাগাম টানা সম্ভব নয়। দিল্লির পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ (সিএসই)-এর এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর (রিসার্চ) অনুমিতা রায়চৌধুরী বলছেন,‘‘ইউরো-৪ ইঞ্জিন ছাড়া কোনও গাড়ি যাতে শহরে ঢুকতে না পারে, সে দিকেও নজর দেওয়া জরুরি।’’
কলকাতায় যে ভাবে যত্রতত্র পার্কিং লট রয়েছে, তাতেও আপত্তি তুলেছেন পরিবেশকর্মীদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, পৃথিবীর উন্নত শহরগুলিতে এমন পার্কিং থাকে না। সেখানে শহরের বাইরে গাড়ি রেখে গণ পরিবহণে চেপে যাতায়াত করেন লোকজন। অনেকেই বলছেন, এই পার্কিং লটে রাশ টানতে হবে। শহরে পার্কিং ফি অনেক বাড়ানো উচিত। তার ফলে যাঁদের নিতান্ত প্রয়োজন, তাঁরাই গাড়ি নিয়ে ঢুকবেন।
দিল্লি সরকার ঠিক করেছে, ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে এক দিন জোড়া নম্বর এবং এক দিন বিজোড় নম্বরের গাড়ি চলবে, এমন সিদ্ধান্তই নিয়েছে দিল্লি সরকার। যদিও পরিবেশবিদদের অনেকে মনে করেন, এই পদ্ধতি লাগু করা কঠিন। পর্যাপ্ত এবং আরামদায়ক গণ পরিবহণের ব্যবস্থা করতে না পারলে অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়বেন না। সে ক্ষেত্রে সমস্যাও দেখা দিতে পারেন। অনেকে আবার বলছেন, শহরের হাওয়ার মান যখন যদি খুব খারাপ হয়, তখনই সাময়িক ভাবে এই ব্যবস্থা লাগু করা যেতে পারে।
মালবাহী ট্রাকের থেকেও মারাত্মক দূষণ ছড়ায় বলে অভিযোগ করেছেন পরিবেশকর্মীদের একাংশ। রাতের শহরে পাহারায় থাকা পুলিশকর্মীদের অনেকেই বলছেন, জেলা বা ভিন রাজ্য থেকে আসা ট্রাকগুলি ভয়ঙ্কর কালো ধোঁয়া ছাড়ে। অনুমিতার মতো পরিবেশবিদদের অনেকেই মনে করেন, যে সব ট্রাক শহরে পণ্য বোঝাই করতে বা খালাস করতে আসছে, তাদের ক্ষেত্রে ইউরো-৪ ইঞ্জিন বাধ্যতামূলক করতে হবে। যারা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার পথে শহর পেরোচ্ছে, তাদের শহরের বাইরের কোনও রাস্তা ব্যবহার করতে নির্দেশ দেওয়া উচিত। ‘‘যত দিন না এই ব্যবস্থা পুরোপুরি লাগু হচ্ছে, তত দিন দূষিত গাড়ির ক্ষেত্রে পরিবেশ কর লাগু করা যেতে পারে,’’ বলছেন অনুমিতা। এর পাশাপাশি নির্মাণস্থলের দূষণ ঠেকানোর জন্য নিয়ম মানতে হবে, বন্ধ করতে হবে খোলা জায়গায় জিনিসপত্র পোড়ানো। কড়া হাতে লাগু করতে হবে পরিবেশ-বিধি।
প্রশ্ন উঠেছে, এমনটা কী সত্যিই কলকাতায় সম্ভব?
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, এ রাজ্যে তো সরকারি পরিবহণ, সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধেই পরিবেশ-বিধি ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে। কাজেই সেই প্রশাসন দূষণকারীদের কতটা কড়া হাতে ঠেকাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy