Advertisement
E-Paper

বিয়ে শুনলে পাড়া মাথায়, জোর বাড়ছে বিলকিসদের

বছর বারো-তেরো বয়স মানেই মেয়ে ‘অনেক’ বড়। কোনও মতে ‘পার’ করে দিলে বাবা-মা নিশ্চিন্ত। কিন্তু কম বয়সে বিয়ে, সন্তান প্রসবে শরীর-মনে কী প্রভাব পড়ে, নিজের দুই দিদিকে দেখে বুঝেছিল কিশোরী বিলকিস খাতুন।

সৌমেন দত্ত

শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৬ ০৪:১৪
হাসিমুখে স্কুলের পথে। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

হাসিমুখে স্কুলের পথে। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

বছর বারো-তেরো বয়স মানেই মেয়ে ‘অনেক’ বড়। কোনও মতে ‘পার’ করে দিলে বাবা-মা নিশ্চিন্ত। কিন্তু কম বয়সে বিয়ে, সন্তান প্রসবে শরীর-মনে কী প্রভাব পড়ে, নিজের দুই দিদিকে দেখে বুঝেছিল কিশোরী বিলকিস খাতুন। বছর চারেক আগে সে মেয়ে জানিয়ে দিয়েছিল— ‘এখন পড়াশোনা, পরে বিয়ে’। কাটোয়ার গাঙ্গুলিডাঙায় মেয়েদের নিয়ে ভাবনার বদলটা শুরু হয়েছিল তখনই। বছর সতেরোর বিলকিসের দেখানো পথে এখন অনেক নাম। ফতেমা, রুবিনা, জাকিরা, ইউসুবা, সবুরা, আসুরা...।

বিলকিসের পথে হাঁটার লোক বেড়েছে বলে গোটা পথ মসৃণ হয়ে গিয়েছে, এমনটা নয়। এখনও ‘সময়ে’ বিয়ে না করলে বাবা-মায়ের শাসন রয়েছে। পাত্রপক্ষের টাকার লোভ রয়েছে। কিন্তু মেয়েরা জেদি হয়েছে। তাই বাবা-মা বিয়ের কথা তুললে কোনও মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বলছে, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব’, কেউ আবার নিজের আপত্তির কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছে প্রশাসনের কর্তাকে।

২০১২ সালের শেষে এই প্রতিবাদ যে শুরু করেছিল, সেই বিলকিস এখন স্থানীয় মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। প্রতিদিন বিকেলে গ্রামের মাসিমা-কাকিমা থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, সকলকে বিনা পয়সায় পড়ায় সে। সেই সঙ্গে অল্প বয়সে প্রসবের পরে অসুবিধে, পণ চেয়ে নির্যাতন— নানা সমস্যাও বোঝায়। গ্রামের বছর তেরো-চোদ্দোর জাকিরা, ইউসুবারা বলে, ‘‘ছোট বয়সে বিয়েতে না বলতে শিখিয়েছে বিলকিস দিদি। বুঝেছি, আগে পড়াশোনা করে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে করলে সংসারটা ভাল ভাবে গোছাতে পারব।’’ তাদেরই সময়বয়সী আলিমা বলে, ‘‘কম বয়সে বিয়ে হলে কত সমস্যা হচ্ছে বা হয়—স্কুলে গিয়ে শুনছি। বিলকিস দিদিও বলেছে। সেই জোরেই বিয়েতে না বলেছি।’’ মেয়ে-দলের আর এক জন— এ বছরই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা ফতেমা বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ আসার কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছে মহকুমাশাসককে। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সে বিয়ে হয়নি।

গাঙ্গুলিডাঙার বেশিরভাগ বাসিন্দা বাড়ি-বাড়ি ঘুরে লোহা-লক্কড়, পুরনো খবরের কাগজ, চুল কিনে আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেন। অনেকে বাড়িতে আলতা তৈরি করেও সংসার চালান। তেমনই কয়েকজন— নজরুল শেখ, জামাল শেখদের দাবি, অভাবের সংসারে মেয়ে বড় হলে চিন্তা বাড়ে। পাত্র পেলে বিয়ে দেওয়ার ভাবনাই মাথায় আসে। তাঁরা বলেন, ‘‘মেয়েরা এখন পড়তে চায়। টাকা জোগাব কোথা থেকে, জানি না! কিন্তু পড়াব।’’ গ্রামের শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের রাঁধুনি রওশন বিবির কথায়, ‘‘মেয়ে এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেনি। আমাদের আর পড়ানোর ক্ষমতা নেই। কিন্তু বিয়ের নাম শুনলেই মেয়ে বলে, ‘পরের বার ঠিক পাশ করব’। কী যে করি!” আর এক মায়ের আক্ষেপ, ‘‘এখন বিয়ের কথা শুনলেই মেয়ে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে।’’

তবে এই পরিস্থিতিতে একটা ‘ভুল’ বিয়ে হওয়ার থেকে মেয়ের জীবনে যে পড়াশোনাটা ঠিকঠাক হওয়া দরকার, সে উপলব্ধিও হচ্ছে অনেকের। বিলকিসের বাবা শাহজামাল শেখ যেমন মানেন, ‘‘মেয়ের পড়ার জেদের কাছে হার মানায় খরচা বেড়েছে। কিন্তু এখন চাই, বিলকিসের জেদ যেন কোনও মতেই নষ্ট না হয়।’’ হেসে বিলকিস বলে, ‘‘এখন আমি একা নই। আমার মতো আরও অনেকে আছে।’’

গাঙ্গুলিডাঙার একটি শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের মুখ্য সহায়িকা জয়ন্তী মল্লিক জানাচ্ছেন, এক সময় ওই কেন্দ্রে পড়ুয়া ধরে আনতে হতো। বিশেষ করে মেয়েদের। তাঁর উচ্ছ্বাস, ‘‘এখন জায়গার অভাবে আর পড়ুয়া নিতে পারছি না। এক জনও স্কুলছুট নেই এলাকায়।’’ বিলকিস এবং গাঙ্গুলিডাঙার ‘আরও বিলকিস’দের পড়াশোনা চালানোর লড়াইয়ে পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য জ্যোৎস্না বিবি, বর্ধমান জেলা শিশুকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান দেবাশিস নাগ।

গাঙ্গুলিডাঙায় অনেক বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছে সদ্য। গ্রামের আঁধার ঘোচানোর কাজটা অবশ্য তার আগেই শুরু করে দিয়েছে বিলকিসরা।

School Student Child marriage
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy