Advertisement
E-Paper

মমতাকে বিঁধতে মমতার পথেই বিজেপি

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরনো অস্ত্রেই তাঁর সরকারকে ঘায়েল করার চেষ্টায় নামল বিজেপি! সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ-বিরোধী আন্দোলনের সময় তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা যে কায়দায় বাম সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করতেন, প্রায় সেই চিত্রনাট্য বীরভূমের মাখড়া গ্রামে অনুসরণ করল বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল! সংঘর্ষের পরে পাড়ুইয়ের মাখড়ায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। বিরোধী নেতা-নেত্রীদের যাতায়াত আটকাতে সেই ১৪৪ ধারাকেই যে পুলিশ ব্যবহার করছে, বিলক্ষণ জানতেন বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপি-র রাজ্য প্রতিনিধিদল মাখড়ায় গিয়ে বুধবারই পুলিশের বাধা পেয়েছিল।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৪৭
গন্তব্য ছিল মাখড়া। তার আগে চৌমণ্ডলপুর গ্রামের কাছে পুলিশ পথ আটকাল কীর্তি আজাদ, মুখতার আব্বাস নকভিদের। প্রথমে বচসা, তার পরে ধস্তাধস্তি ও শেষে গ্রেফতারি। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

গন্তব্য ছিল মাখড়া। তার আগে চৌমণ্ডলপুর গ্রামের কাছে পুলিশ পথ আটকাল কীর্তি আজাদ, মুখতার আব্বাস নকভিদের। প্রথমে বচসা, তার পরে ধস্তাধস্তি ও শেষে গ্রেফতারি। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরনো অস্ত্রেই তাঁর সরকারকে ঘায়েল করার চেষ্টায় নামল বিজেপি! সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ-বিরোধী আন্দোলনের সময় তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা যে কায়দায় বাম সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করতেন, প্রায় সেই চিত্রনাট্য বীরভূমের মাখড়া গ্রামে অনুসরণ করল বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল!

সংঘর্ষের পরে পাড়ুইয়ের মাখড়ায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। বিরোধী নেতা-নেত্রীদের যাতায়াত আটকাতে সেই ১৪৪ ধারাকেই যে পুলিশ ব্যবহার করছে, বিলক্ষণ জানতেন বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপি-র রাজ্য প্রতিনিধিদল মাখড়ায় গিয়ে বুধবারই পুলিশের বাধা পেয়েছিল। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল যাওয়ার আগে রাজ্য প্রশাসনের তরফেও বিজেপি-কে ১৪৪ ধারার কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তা সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার মুখতার আব্বাস নকভির নেতৃত্বে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতারা মাখড়া গেলেন, পুলিশের বাধা পেয়ে ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করলেন এবং গ্রেফতার হলেন। সেই গ্রেফতারির প্রতিবাদেই রাজ্য জুড়ে বিক্ষোভ-অবরোধে নেমে পড়লেন বিজেপি সমর্থকেরা। বিভিন্ন জেলায় গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় বিকেলে আচমকা অবরোধে ভোগান্তিতে পড়লেন অসংখ্য মানুষ।

অবিকল মমতা মডেল! যে মডেলে সরকারকে এবং কিছুটা জনতাকে বিপাকে ফেলেও শক্তি প্রদর্শন করে নেওয়া গেল। বিরোধী রাজনীতির পরিসর দখলে আরও এক কদম এগোনো গেল!

অবশ্য বিজেপি একা নয়। হয়তো বিজেপির ঠেলাতেই মাখড়া-কাণ্ডে সময় নষ্ট করেনি অন্য বিরোধীরাও। বাম সাংসদ ও বিধায়কদের প্রতিনিধিদল বুধবার মাখড়ায় পুলিশের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ঢুকতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদলকে বাধা দেওয়ার প্রতিবাদে আজ, শুক্রবার রাজ্য জুড়ে ‘ধিক্কার দিবস’ পালন এবং রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। আজই একই বিষয়ে রাজ্যপালের কাছে যাচ্ছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের নেতৃত্বে বাম বিধায়কেরা। বসে নেই কংগ্রেসও। বীরভূমের পুলিশ সুপারের দফতরে গিয়ে এ দিনই রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিয়ে এসেছেন যুব কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি অরিন্দম ভট্টাচার্য। আগামী ৮ নভেম্বর এসপি দফতর ঘেরাও করবে যুব কংগ্রেস। তার আগে কাল, শনিবার মাখড়ায় যাচ্ছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী।

রাজ্য জুড়ে অস্থিরতার প্রতিবাদ জানিয়ে বিরোধীরা যখন তাঁর অস্ত্রই তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করছেন, তখন কী করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা? তিনি এ দিন ব্যস্ত ছিলেন আমলা ও পারিষদদের নিয়ে সাগরে প্রমোদ-বিহারে! সাগরে গিয়েই এ দিন বিজেপি-র নাম না-করে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, “আমরা উন্নয়ন করব। দাঙ্গা করে, হিংসা করে উন্নয়ন রোখা যাবে না!” ঘটনাচক্রে, মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তায় সাগরে যাওয়ার পথে ডায়মন্ড হারবারে বিজেপির অবরোধে আটকে গিয়েছিল পুলিশ-প্রশাসনের কয়েকটি গাড়িও!

নকভির নেতৃত্বে সাংসদ কীর্তি আজাদ ও উদিত রাজের সঙ্গেই এ দিন পাড়ুই পৌঁছন রাহুলবাবু, রাজ্য নেতা রীতেশ তিওয়ারি, বিশ্বপ্রিয় রায়চৌধুরী, প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবশ্রী রায়চৌধুরী, জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল, সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ প্রমুখ। গোটা পনেরো গাড়ির কনভয় নিয়ে দুপুর পৌনে ১টা নাগাদ মাখড়া থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে চৌমণ্ডলপুর গ্রামের কাছে পৌঁছন তাঁরা। ক’দিন আগে বিজেপি প্রভাবিত এই গ্রামেই বোমা উদ্ধার করতে গিয়ে আক্রান্ত হন পাড়ুই থানার ওসি। প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ছিলেন শতাধিক কর্মী-সমর্থক। পুলিশের ব্যারিকেড ছিল গ্রামের আগে মাদ্রাসার কাছেই। নকভিরা গাড়ি থেকে নেমে জানতে চান, কেন তাঁদের আটকানো হচ্ছে। এসডিপিও (রামপুরহাট) কোটেশ্বর রাও এবং ওসি (খয়রাশোল) সঞ্জয় শ্রীবাস্তব বলেন, “১৪৪ ধারা আছে। পরিস্থিতি অশান্ত। আপনাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।”

নকভি বলেন, “নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কোথাও যাওয়া থেকে এ ভাবে আটকে দেওয়া যায় নাকি?” পুলিশ-কর্তারা উত্তর দেননি। নকভি ফের বলেন, “দুই বা চার জন প্রতিনিধিকে পুলিশের সঙ্গেই মাখড়া যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার হোক।” ওই অনুমতি কোনও ভাবেই দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন এসডিপিও। কিন্তু নকভিরা বলেন, ১৪৪ ধারা মেনেই তো দু’জন যেতে চাইছেন!


মাখড়া-কাণ্ডের প্রতিবাদে বিজেপির মিছিল। সল্টলেকে বৃহস্পতিবার। ছবি: শৌভিক দে।

এই কথোপকথন চলাকালীনই চৌমণ্ডলপুর থেকে বিজেপি সমর্থক বহু পুরুষ-মহিলা চলে আসেন। তাঁদের দেখিয়ে নকভি পুলিশ-কর্তাদের বলেন, “শয়ে শয়ে গ্রামবাসী আসছেন অভিযোগ জানাতে। মাখড়াতেও সে কারণেই আমরা যাচ্ছি।” পুলিশ তখন জানিয়ে দেয়, জোর করে ঢুকতে গেলে বিজেপি নেতাদের গ্রেফতার করা হবে। এর পরেই পুলিশ এবং বিজেপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে তুমুল ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। প্রথমে রীতেশ ব্যারিকেড ঠেলে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পুলিশ লাঠি দিয়ে তাঁকে আটকায়। পিছন থেকে দলের কর্মী-সমর্থকেরা এসে বেশ কয়েকটি ব্যারিকেড তুলে সরিয়ে দেন। নকভি, রাহুল, কীর্তিদের সঙ্গেও ধস্তাধস্তি হয়। পিছন থেকে চলছিল স্লোগান। ক্ষুব্ধ নকভি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে আইনশৃঙ্খলা ক্রমেই ভেঙে পড়ছে। অথচ পুলিশ অন্যায় ভাবে আমাদের পথ আটকাচ্ছে।”

পুলিশ, র্যাফ এবং কমব্যাট ফোর্সের বিপুল বাহিনী বিজেপি নেতাদের ধাক্কা দিতে দিতে পুলিশ ভ্যানে তুলে দেয়। দলীয় কর্মীদের ভিড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়েই ভ্যান বার করে নিয়ে যায় পুলিশ। নকভিদের গ্রেফতার করে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখনও মাঠের আল ধরে দৌড়ে আসছেন বহু পুরুষ-মহিলা। ভ্যানের ভিতর থেকে হাত নেড়ে তাঁদের পাশে থাকার কথা বলেন নকভি, কীর্তিরা। বিজেপি নেতাদের সোজা নিয়ে যাওয়া হয় পাড়ুই থানায়। দুপুর সওয়া দু’টো পর্যন্ত তাঁদের সেখানে রাখা হয়। শয়ে শয়ে কর্মী-সমর্থকেরাও ততক্ষণে পাড়ুই থানা চত্বরে এসে স্লোগান শুরু করেছেন। থানায় হাজির ছিলেন বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া। ব্যক্তিগত বন্ডে পরে বিজেপি নেতাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

থানা থেকে বেরিয়ে নকভি বলেন, “সাধারণ মানুষই আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে গ্রামে ঢোকানোর চেষ্টা করেছিলেন। এই দৃশ্য দেখে আমরা সত্যিই অভিভূত। পুলিশ-তৃণমূল মিলে আমাদের বেআইনি ভাবে আটকানোর চেষ্টা করেছে। আমরা সব ঘটনা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানাব।” রাহুলবাবু বলেন, “আমাদের গ্রেফতার করে রাজ্য সরকার দেখিয়ে দিল, পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র বলে কিছু নেই!” নন্দীগ্রামে সিপিএম এবং পুলিশ যে কায়দা নিয়েছিল, ফের তার সঙ্গে পাড়ুইয়ের তুলনা করেছেন রাহুলবাবু। নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলনের জেরে লড়াইয়ের সঙ্গে পাড়ুইয়ে গ্রাম দখলের সংঘর্ষের তুলনায় অবশ্য তীব্র আপত্তি করেছেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। আর সূর্যবাবু বলেছেন, “এক দিকে সংখ্যালঘু সন্ত্রাসবাদ অশান্তি বাধাতে চাইছে। আর এক দিকে আরএসএস সক্রিয়তা বাড়াচ্ছে।

আর এর মাঝখানে রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে।” গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার পথে বিরোধীদের বাধা দেওয়ারও তীব্র প্রতিবাদ জানান তিনি।

বস্তুত, বুধবারও কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং বিজেপি-র রাজ্য প্রতিনিধিদলের তরফে দু’জন করে সদস্য পুলিশের সঙ্গেই মাখড়ায় ঢোকার অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। পুলিশ তা খারিজ করে দেয়। এ প্রসঙ্গে কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “১৪৪ ধারা একটি প্রশাসনিক নির্দেশ। তার ফলে চার জন বা তার বেশি লোক জমায়েত হলে পুলিশ আটকাতে পারে। কিন্তু বীরভূমে পুলিশ এক-দু’জনকেও আটকাচ্ছে! এটাও বেআইনি কাজ করা হচ্ছে।”

makhra parui birbhum west bengal state news online state news mamata banerjee west bengal CM state government mamata banerjee's way BJP attacked mamata
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy