Advertisement
০৬ মে ২০২৪
নানুরে নীরব

স্কুলের পথে বোমার ভয়

প্রবাদ নয়, রাজ্য রাজনীতিতে পালাবদলের আগে এমনই কথার চল ছিল জেলার এই বিধানসভা এলাকাটি ঘিরে। কেন না, একসময় এলাকায় ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে কোথাও সিপিএম-তৃণমূল, কোথাও বা বাম-শরিকদের গোলাগুলিতে সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত নানুরের জনজীবন।

নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে উদ্ধার হওয়া বোমা। —ফাইল ছবি

নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে উদ্ধার হওয়া বোমা। —ফাইল ছবি

নিজস্ব সংবাদদাতা
নানুর ও বোলপুর শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৪৫
Share: Save:

বোমার শব্দ না শুনলে নানুরের ঘুম ভাঙে না!

প্রবাদ নয়, রাজ্য রাজনীতিতে পালাবদলের আগে এমনই কথার চল ছিল জেলার এই বিধানসভা এলাকাটি ঘিরে। কেন না, একসময় এলাকায় ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে কোথাও সিপিএম-তৃণমূল, কোথাও বা বাম-শরিকদের গোলাগুলিতে সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত নানুরের জনজীবন। বিধানসভা ভোট যতো এগিয়ে আসছে, নানুর ফিরছে সেই নানুরেই। তাতে, তখন রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে থাকা সাধারণকে কার্যত উলুখাগড়ার মতোই দিন কাটাতে হচ্ছে। তবে এ বার আর শাসক বনাম বিরোধী অথবা শরিকি কোন্দল নয়। তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে শিকেয় উঠেছে নানুর সংলগ্ন বোলপুরের চারটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া! পরিস্থিতি এমনই, একটি স্কুলের ৪০ জন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সম্প্রতি মহকুমা পুলিশ অফিসারের কাছে এলাকায় শান্তি ফেরানোর দাবিতে চিঠি পাঠিয়েছে। যদিও, মহকুমা পুলিশ আধিকারিক স্বীকার করেননি ওই চিঠি প্রাপ্তির কথা।

নানুর বিধানসভা কেন্দ্রের আওতাধীন ১৭টি পঞ্চায়েতের ক্ষমতা তথা এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নতুন নয়। একসময় ওইসব পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখলের জন্য দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামীদের সঙ্গে বিধায়ক গদাধর হাজরা এবং যুব নেতা কাজল সেখের টক্কর লেগেই ছিল। পরে গদাধর যোগ দেন অনুব্রত শিবিরে। তারপর থেকেই একই কারণে গদাধর অনুগামীদের সঙ্গে সংঘাত বাঁধে কাজল অনুগামীদের। বর্তমানে নানুরের ৯টি এবং বোলপুরের ৩ পঞ্চায়েতের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কাজলের হাতে।

ঘটনা হল, রাজনৈতিক পালাবদলের পর নানুর এলাকা আপাতঃশান্ত থাকলেও, বিধানসভা ভোট যতো এগিয়ে আসছে নিত্য বোমা-বারুদে ভারী হয়ে উঠছে অজয় সংলগ্ন গ্রামের বাতাস। বোলপুরের বাহিরী-পাঁচশোয়া এবং সিঙ্গি পঞ্চায়েতের ক্ষমতা তথা লাগোয়া অজয়ের বালির ঘাটের দখল নেওয়াকে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাস ধরে দু’পক্ষের গোলাগুলিতে তেতে ওঠছে এলাকার বহু গ্রাম। মাসুল দিতে হচ্ছে স্কুল পড়ুয়াদেরও। স্থানীয় সূত্রেই জানা গিয়েছে, প্রতিটি গ্রামেই দু’পক্ষের কর্মী-সমর্থক রয়েছেন। গোষ্ঠী সংঘর্ষের জেরে বিভিন্ন সময় প্রায় প্রতিটি গ্রাম থেকে কর্মী-সমর্থকদের সপরিবারে দিনের পর দিন গ্রাম ছাড়া হয়ে থাকতে হচ্ছে। যে সব পরিবার গ্রামে রয়েছেন আতঙ্কে তাঁদের ছেলে মেয়েরাও দিনের পর দিন স্কুলে যেতে পারছে না। বাড়িতেও বই খুলে মন বসাতে পারছে না তারা। আচমকা গোলাগুলির শব্দে আলো নিভিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী। এলাকার স্কুলগুলিতেও মিলেছে ওই অভিযোগের সত্যতা।

বাহিরী-পাঁচশোয়া এবং সিঙ্গি পঞ্চায়েত— এই দুটি পঞ্চায়েত এলাকায় রয়েছে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ৪টি স্কুল। ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা ৫৪৩৪। স্কুলগুলি থেকে এবারে মাধ্যমিকে বসবে ৫৪২ জন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩২০ জন। তার মধ্যে পাঁচসোয়া রবীন্দ্র বিদ্যাপীঠে টেস্টে উত্তীর্ণ হয়েও ৫ জন মাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপই করেনি। পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণিতে পর্যন্ত ৫০ জন পড়ুয়াও বাৎসরিক পরীক্ষাতে বসেনি। প্রায় সমসংখ্যক ছাত্রছাত্রী কয়েকমাস ধরে স্কুলেও গড়হাজির। সিঙ্গি হাইস্কুলেও ১ জন পড়ুয়া ফর্মফিলাপ করেনি। বাৎসরিক পরীক্ষায় বসেনি ৬০ জন। স্কুলে টানা অনুপস্থিতিও ৫০ জনের বেশি। ওই স্কুলের ৪০ জন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এলাকায় সুস্থ পরিবেশ ফেরানোর দাবিতে ডাক মারফৎ বোলপুরের এসডিপিও-র কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রের খবর।

‘‘যখন ছোট ছিলাম, ঘুম ভেঙে যেত বোমার শব্দে। সব থেমে গিয়েছিল। আবার শুরু হয়েছে, রাত হলেই বোমা পড়ে। একটা আধটা নয়, মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা পড়ে। ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। পড়ায় মন বসে না। খালি মনে হয়, সকালে কার লাশ দেখব কে জানে! জানি না, কবে থামবে ওদের পার্টির হুজতি। পড়তে আর ভালো লাগে না।’’ বলছিল পাঁচসোয়া রবীন্দ্র বিদ্যাপীঠের এক পড়ুয়া। একই কথা বলছিল সিঙ্গি গ্রামের এক ছাত্র। ‘‘স্কুলে যাই না। বাবা-মা যেতে দেয় না। কেন না, ক’দিন আগে বালির-ঘাট নিয়ে যা অশান্তি হল! রাস্তায় বোমা পড়েছিল। স্কুলের রাস্তায় বোমার দাগ দেখেছিলাম। ভয় পেয়ে বাড়িতে বলার পর, একা স্কুলে পাঠাতে ভয় করে মায়ের।’’

স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বপন কুমার রায় অবশ্য বলেন, ‘‘চিঠির ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। অভিভাবকরাই বলতে পারবেন। পড়ুয়ারা কেন পরীক্ষায় বসেনি, কেনই বা স্কুলে আসছে না তাও বলতে পারব না।’’ তবে পাঁচশোয়া রবীন্দ্র বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক সীতারাম মণ্ডল, নাহিনা হাইস্কুলের পরিচালন সমিতির সম্পাদক গোলাম আব্বাসদের দাবি, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই ওই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সুস্থতা ফেরাতে প্রশাসন এখনই পদক্ষেপ না নিলে অবস্থার আরও অবনতি হবে।

সিঙ্গি, পাঁচশোয়া গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশ বলছেন, ‘‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে এলাকার বেশ কিছু পরিবার দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে গ্রাম ছাড়া রয়েছেন। যেসব পরিবারের পুরুষেরা বাইরে রয়েছেন, সেইসব পরিবারের ছেলেমেয়েরাও আতঙ্কে স্কুলে যেতে পারছে না। এলাকা দখলের জন্য গোলাগুলি করছে তৃণমূলের দুটি গোষ্ঠী, আর স্কুল পড়ুয়াদেরও তার মাসুল দিতে হচ্ছে।’’

বিধায়ক গদাধর হাজরা অবশ্য গোষ্ঠীদ্বন্বের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেন, ‘‘কিছু দুষ্কৃতীর জন্যই ওই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এলাকায় শান্তি ফেরানোর জন্য আমরাও পুলিশকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’’ কোন্দলের কথা উড়িয়ে দিয়েছেন কাজল সেখও। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশই তদন্ত করে দেখুক কারা ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত। আমরাও চাই তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করুক পুলিশ।’’

বোলপুরের এসডিপিও অম্লানকুসুম ঘোষ জানান, ওই ধরণের কোনও চিঠি আমি এখনও পাইনি। পেলে খতিয়ে দেখব। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

state news nanur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE