বাসমালিকদের অভিযোগ, কলকাতায় বাসের সংখ্যার অনুপাতে কর্মীর সংখ্যা অপ্রতুল। ছবি: সুমন বল্লভ
শহরের রাস্তায় বিভিন্ন রুটের বা একই রুটের দু’টি বাসের মধ্যে রেষারেষি এবং তার জেরে দুর্ঘটনার পিছনে কমিশন প্রথা দায়ী বলে অভিযোগ উঠছে বহু দিন ধরেই। যদিও কমিশন প্রথাই দুর্ঘটনার একমাত্র কারণ, এই যুক্তি মানতে নারাজ বাসমালিকেরা। সম্প্রতি বেসরকারি বাসের কমিশন প্রথা তুলে দিতে উদ্যোগী হয়েছে পরিবহণ দফতর। কিন্তু বাসমালিকদের একাংশের অভিযোগ, এই ব্যবস্থা তুলে দিলে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলায় বেসরকারি পরিবহণ টিকিয়ে রাখাই দুষ্কর হবে। এ প্রসঙ্গে তাঁরা রাজ্যের অন্যান্য জেলার সঙ্গে কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা এবং হাওড়ার পরিস্থিতিগত পার্থক্যের কথা তুলে ধরছেন। এ-ও জানাচ্ছেন, সরকার বিষয়টি নিয়ে জবরদস্তি করলে পরিষেবা গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
কী বলছে বাসমালিক সংগঠনের একাংশ?
জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেট্সের সাধারণ সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ‘‘কলকাতা এবং শহরতলিতে বাসের সংখ্যা জেলার তুলনায় অনেক বেশি। রুটের পরিকল্পনায় সামঞ্জস্যের অভাবে একই রুটে একাধিক বাস চলে। ফলে বাস পিছু আয় কমে যায়। বিকল্প পরিকল্পনা ছাড়া সরকারের প্রস্তাব কার্যকর করা কার্যত অসম্ভব।’’
আপত্তি কোথায়
• জেলায় কমিশন প্রথা না থাকা সত্ত্বেও দুর্ঘটনা ঘটে।
• কলকাতায় রাস্তার পরিসর কম, রয়েছে যত্রতত্র পার্কিংয়ের সমস্যা। রাস্তা পরিষ্কার থাকলে দুর্ঘটনা কমবে।
• রুট পুনর্গঠন করে বিকল্প পরিকল্পনা জরুরি।
• বাসকর্মীর সঙ্কট। একই বাস ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকে চালান, ফলে মাসিক বেতন কার্যকর করা শক্ত।
• বাস পিছু আয় জেলার তুলনায় কম। ভাড়া বৃদ্ধিতেও বৈষম্যের অভিযোগ।
উদাহরণ হিসেবে বাসমালিক সংগঠনের এক নেতা জানান, ডানলপ থেকে বি বা দী বাগ পর্যন্ত কম-বেশি আট কিলোমিটার পথে ১৯টি মিনিবাস চলে। বনহুগলি থেকে বেহালা রুটে চলে ২২টি বাস। টবিন রোড থেকে বি বা দী বাগের মধ্যে ১০টি মিনিবাস চলে। আবার সিঁথি থেকে ধর্মতলার মধ্যে যাতায়াত করে ১৭টি বাস। সব ক’টি রুটেরই একটা বড় অংশ যায় চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ হয়ে। ফলে, একই পথে এত বাস থাকায় কমে যায় বাস পিছু আয়। যে কারণে তাদের মধ্যে যাত্রী তোলার জন্য রেষারেষি বাড়ে। রুট পুনর্গঠন না করে শুধু কমিশন প্রথা তুলে দিলে এই রেষারেষি বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম, এমনটাই মনে করছেন বাসমালিকেরা।
বর্তমান ব্যবস্থায় বাসচালক মোট টিকিট বিক্রির ১২-১৪ শতাংশ পান। যা টাকার অঙ্কে সাড়ে সাতশো। কন্ডাক্টর পান ৬-৮ শতাংশের মতো, গড়ে ৪৫০ টাকা।
কিন্তু জেলার ক্ষেত্রে কমিশন প্রথা ছাড়াই বাস চলছে কী করে?
বাসমালিকদের একাংশের অভিযোগ, জেলায় বাসের সংখ্যা তুলনামূলক বিচারে অনেক কম। বেশির ভাগ বাস দূরপাল্লার। ফলে বাস পিছু আয়ও বেশি। সম্প্রতি সংশোধিত ভাড়ার যে তালিকা সরকার প্রকাশ করেছে, তাতে জেলায় কিলোমিটার পিছু ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৭০ পয়সা।
কলকাতায় প্রতি কিলোমিটারে সেই বৃদ্ধি ১৫-২৫ পয়সার মধ্যে। ফলে বাস চালানো ক্রমে অলাভজনক হয়ে পড়ছে, বলছেন তাঁরা।
বাসমালিকদের আরও অভিযোগ, কলকাতায় বাসের সংখ্যার অনুপাতে কর্মীর সংখ্যা অপ্রতুল। সারা মাসের বিভিন্ন দিনে পালা করে বাস চালান মাত্র ৭-৮ জন কর্মী। মিনিবাস অপারেটর্স কো-অর্ডিনেশন কমিটির সহ-সম্পাদক প্রদীপনারায়ণ বসু এবং স্বপন ঘোষ জানান, কর্মী সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় সপ্তাহে পাঁচ দিন যত বাস নামে, শনি-রবিবার তার চেয়ে অনেক কম বাস চলে।
এ ছাড়া, বাসকর্মীদের গড়ে সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রাস্তায় থাকতে হয়। ফলে যাত্রার মাঝপথে শিফ্ট বদল অসুবিধাজনক বলেও অভিযোগ মালিকদের।
বাম আমলে সিটু কমিশন প্রথা তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করলেও এখন তাদের অবস্থান উল্টো। সিটুর রাজ্য সভাপতি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “এক সময়ে কমিশন প্রথা বন্ধের দাবিতে আমরা আন্দোলন করলেও পরে ওই অবস্থান থেকে সরে আসি। কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী জেলার ক্ষেত্রে জোর করে কমিশন প্রথা তুলে দেওয়ার ভাবনা অবৈজ্ঞানিক।’’ যদিও আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভানেত্রী দোলা সেন বলেন, ‘‘আমরা প্রথম থেকেই কমিশন প্রথা তুলে দেওয়ার পক্ষে। বাসকর্মীদের নির্দিষ্ট বেতনের ব্যবস্থা করতে হবে।’’
বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের সহ-সভাপতি দীপক সরকার বলেন, ‘‘পথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার যা সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা তাকেই সমর্থন করব। তবে দুর্ঘটনা কী ভাবে কমানো যায়, সেটাও সরকারকেই খতিয়ে দেখতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে চালকদের দায়বদ্ধতাও।’’
পরিবহণ দফতর সূত্রে খবর, সরকার এ নিয়ে আপস করতে নারাজ। বাসমালিকদের কঠোর ভাবে কমিশন প্রথা বন্ধ করতে বলা হয়েছে। পরিষেবা ব্যাহত হলে প্রয়োজনে বাড়তি বাস চালিয়ে জনপরিবহণ সচল রাখা হবে বলে জানিয়েছেন পরিবহণ দফতরের এক কর্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy