E-Paper

সন্দীপের নির্দেশেই আত্মহত্যার তত্ত্ব

চিকিৎসক-পড়ুয়াকে ওই অবস্থায় দেখেই তাঁর মনে হয়েছিল, মেয়েটির উপরে যৌন নির্যাতন হয়েছে এবং মেয়েটি আর বেঁচে নেই।

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২৫ ০৯:০০
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

‘আপনাদের মেয়ে মনে হয় আত্মহত্যা করেছে।’

সেমিনার রুমে চিকিৎসক-পড়ুয়ার রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত দেহ যাঁরা দেখেছিলেন, ডাক্তার থেকে শুরু করে সাধারণ হাসপাতাল কর্মী, ঘটনা সম্পর্কে আর কিছু জানা যাক বা না যাক, সকলেই সেই মুহূর্তে অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন শুধু খুন নয়, ওই চিকিৎসক এক ভয়াবহ যৌন নিগ্রহেরও শিকার। তা হলে হাসপাতালের সহকারী সুপার পদে কর্মরত এক আধিকারিক কী ভাবে তা আত্মহত্যা বলে দাগিয়ে দিলেন?

এক বছর ধরে এই প্রশ্নের উত্তর অজানা থেকে গিয়েছে রাজ্যবাসীর কাছে। অথচ চিকিৎসক-পড়ুয়ার বাবা-মাকে ফোনে বলা সহকারী সুপারের ওই বাক্য ছিল অলিখিত এক চিত্রনাট্যের অংশ। এক বছর আগের ওই ফোনালাপের কারণ খুঁজতে গিয়ে যে তথ্য উঠে এসেছে আনন্দবাজারের কাছে, তাতে স্পষ্ট হয়ে যায় ওই আত্মহত্যার তত্ত্বের নেপথ্যে নির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা।

পুলিশ এবং আদালত সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৯ অগস্ট, ২০২৪ সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর সুমিত রায় তপাদার সেমিনার রুমে পৌঁছন। চিকিৎসক-পড়ুয়াকে ওই অবস্থায় দেখেই তাঁর মনে হয়েছিল, মেয়েটির উপরে যৌন নির্যাতন হয়েছে এবং মেয়েটি আর বেঁচে নেই। নিশ্চিত হওয়ার জন্য মোবাইলের টর্চ জ্বেলে চোখের উপর ফেলেছিলেন তিনি। দেখেছিলেন চোখের মণি স্থির। এর পরেই তিনি ফোন করেছিলেন বিভাগীয় প্রধান অরুণাভ দত্ত চৌধুরী এবং অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে। সন্দীপ ফোন ধরেননি। কিন্তু ঘটনাটি জানিয়ে সন্দীপকে মেসেজ করা মাত্র ফোন আসে সুমিতের কাছে। সন্দীপ নির্দেশ দেন দ্রুত দেহটি মর্গে পাঠিয়ে দেওয়ার। যেখানে একটি দেহ দেখামাত্রই বোঝা যাচ্ছে মৃত্যুটি অস্বাভাবিক, সেখানে পুলিশ আসার আগেই দেহ মর্গে পাঠানোর ওই নির্দেশ হতবাক করে দিয়েছিল সেখানে উপস্থিত ডাক্তারদের।

সে দিনের কথা উঠতেই বৃহস্পতিবার হাসপাতালের এক কর্তা বললেন, ‘‘ঘটনাচক্রে ঠিক তার আগেই পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। তা না হলে এই ঘটনা পুরোপুরি ধামাচাপা পড়ে যেত। এর ঠিক পরের ধাপেই সহকারী সুপার যে ফোনগুলি করেছিলেন ওই মেয়েটির বাবা-মাকে, তার মধ্যে শেষ বার ফোনে ওই আত্মহত্যা সংক্রান্ত বাক্যটি তাঁকে বলতে বলা হয়েছিল।’’

ঠিক কী ঘটেছিল? হাসপাতালের একটি সূত্রের দাবি, সুমিতের ফোন অধ্যক্ষের কাছে পৌঁছনোর আগেই তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান অরুণাভ দত্ত চৌধুরী সন্দীপ ঘোষকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। সুমিত যখন সন্দীপকে ফোন করেন, তখন সন্দীপ বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত (যদিও সুমিতকে তিনি সে কথা জানাননি)। কারণ ততক্ষণে ‘চিত্রনাট্য’ রচনা হতে শুরু করেছে। যার প্রথম ধাপ দেহটি দ্রুত মর্গে পাঠাতে বলা। কিন্তু শুরুতেই হোঁচট। কারণ, তত ক্ষণে পুলিশ বিষয়টি জেনে ফেলেছে। ‘প্ল্যান-এ’ কাজে না লাগায় এর পর ‘প্ল্যান-বি’।

পুলিশ এবং আদালতের তথ্য অনুযায়ী, বিভাগীয় প্রধান সেমিনার রুমে এলেও যেখানে দেহটি পড়ে ছিল, সেখানে আসেননি। তিনি একবার ঘরে ঢুকেই সহকারী সুপার সুচরিতা সরকারকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। হাসপাতাল সূত্রের খবর, এর পরেই অধ্যক্ষের সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষণ কথা হয় সহকারী সুপার এবং বিভাগীয় প্রধানের। অভিযোগ, অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের নির্দেশেই সুচরিতা আত্মহত্যার কথাটি বলেন। এই কথোপকথনের সময়ে বিভাগীয় প্রধান ছাড়াও দু’জন চিকিৎসক-পড়ুয়া সেখানে ছিলেন। আত্মহত্যার কথা যে অধ্যক্ষ বলতে বলেছেন সে কথা বাইরে গেলে ‘তার ফল ভাল হবে না’— এই হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছিল। যে কারণে আত্মহত্যা কেন বলা হল সে নিয়ে বারংবার জিজ্ঞাসার পরেও সুচরিতা কারও নাম বলেননি। শুধু জানিয়েছিলেন, বিভাগীয় প্রধান বাড়ির লোককে খবর দিতে বলেছেন। কিন্তু খবর দেওয়ার নাম করে একটি ভুল তথ্য তিনি কেন দিলেন, হাজারো তিরস্কারেও সে বিষয়ে তিনি নীরব ছিলেন। আর জি করে তাঁর এক প্রাক্তন সহকর্মী এ দিন বলেন, ‘‘সন্দীপ গ্রেফতার হওয়ার পরেও কেন ও সবটা বলে দিচ্ছে না সে নিয়ে প্রশ্ন তুললে সুচরিতা আমাদের বলেছিল, সন্দীপের মতো প্রভাবশালী লোক ফের বাইরে বেরোবেই। তখন ওর সমস্যা হতে পারে। শুধু আত্মহত্যার তকমা দেওয়ার চেষ্টা নয়, ওই দিন ওই সময়ে আরও কিছু পরিকল্পনা হয়েছিল যেটা সম্ভবত বিভাগীয় প্রধান এবং সুচরিতা জানেন।’’

৯ তারিখ বেলা গড়ালে অধ্যক্ষ জরুরি বৈঠক ডেকেছিলেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছে রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের কয়েক জন চিকিৎসক দেখেন ঘর ভেতর থেকে বন্ধ। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সেই ঘরে তখন অধ্যক্ষ, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান ছাড়া অন্য কয়েকটি বিভাগের কয়েক জন চিকিৎসক এবং কয়েক জন পুলিশ কর্মী উপস্থিত ছিলেন। রেসপিরেটরি মেডিসিনের কয়েক জন চিকিৎসক সেখানে ঢুকতে গেলে তাঁদের বাধা দেওয়া হয় এবং বলা হয়, 'অধ্যক্ষের নির্দেশ আছে, কাউকে ভেতরে যেতে দেওয়া হবে না'। বৈঠক শেষ হওয়ার পরে ভিতরে যাঁরা ছিলেন তাঁরা বিভিন্ন দিকে ছিটকে যান। ওই ঘরে কিছু পরে ফের ডাক পড়ে সহকারী সুপার সুচরিতার।

এক বছর পরেও অবশ্য তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান এবং সহকারী সুপার কেউই কথা বলতে চাননি। তাঁরা ফোন ধরেননি। উত্তর দেননি মেসেজেরও।

অথচ হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে যথাযথ নয় সে কথা পুলিশকে দেওয়া বয়ানে জানিয়েছিলেন অরুণাভ। তাঁর সহকর্মীরা জানিয়েছেন, ওই চিকিৎসক-পড়ুয়া যে সমস্যায় আছেন সে কথাও বিভাগীয় প্রধান জানতেন। ওই ঘটনার কয়েক দিন আগে ওই বিভাগে এক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ওষুধের গুণমান নিয়ে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেনওই পড়ুয়া। সে নিয়ে অধ্যক্ষের রোষদৃষ্টিতে ছিলেন তিনি। সে কথাও কারও অজানা ছিল না। কিন্তু এই ঘটনার এক বছর পরেও তিনি সে নিয়ে কথা বলতে চাননি। ঠিক যে ভাবে ওই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা নিয়েও কিছু বলতে চাননি সহকারী সুপার।

একটা মৃত্যু ঘিরে দেশ জোড়া আন্দোলন সত্ত্বেও নিষ্ফল একটি বছর পেরিয়েছে। সেই সকালের চিত্রনাট্যের উন্মোচন এখন ফের স্পষ্ট করে দিচ্ছে, কতটা গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছিল পরতে পরতে। কিন্তু এখনও অনেকেরই মুখে কুলুপ। তাই বছর ঘুরলেও অজানা বহু সত্যই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

RG Kar Rape and Murder Case Kolkata Doctor Rape and Murder

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy