Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

শিল্পের চেয়ে শিল্পীদের সান্নিধ্যেই স্বচ্ছন্দ মমতা

বছর দুয়েক আগে এক সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, “শুধু কি কাঠের শিল্প, সিমেন্টের শিল্প, লোহার শিল্পই শিল্প?” জানিয়েছিলেন, তাঁর ভাবনায় যাত্রা-নাটক-সিনেমা-সঙ্গীত সবই শিল্প এবং সেই শিল্পকেই তিনি বেশি করে তুলে ধরবেন। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। সংস্কৃতি-জগতের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন পর্যন্ত যত সময় খরচ করেছেন, তার অর্ধেকও শিল্পমহলের বরাতে জোটেনি।

কলকাতা পুলিশের ‘জয় হে’-অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিপাশা বসু। শনিবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

কলকাতা পুলিশের ‘জয় হে’-অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিপাশা বসু। শনিবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৪ ০৩:০৯
Share: Save:

বছর দুয়েক আগে এক সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, “শুধু কি কাঠের শিল্প, সিমেন্টের শিল্প, লোহার শিল্পই শিল্প?” জানিয়েছিলেন, তাঁর ভাবনায় যাত্রা-নাটক-সিনেমা-সঙ্গীত সবই শিল্প এবং সেই শিল্পকেই তিনি বেশি করে তুলে ধরবেন।

যেমন ভাবা, তেমন কাজ।

সংস্কৃতি-জগতের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন পর্যন্ত যত সময় খরচ করেছেন, তার অর্ধেকও শিল্পমহলের বরাতে জোটেনি। তাই যে মুখ্যমন্ত্রী ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সামনের সারিতে বসে ‘কলকাতার রসগোল্লা’ নাচ দেখেন, ব্রিগেডের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘পাগলু থোড়া সা কর লে রোম্যান্স’ উপভোগ করেন, নজরুল মঞ্চ বা সায়েন্স সিটি প্রেক্ষাগৃহে ‘কত যে সাগর নদী পেরিয়ে এলাম’-এর সঙ্গে ঘাড় নাড়েন, ইকো-পার্কে সামিয়ানার নিচে তিন ঘণ্টার ফিল্ম শো দেখতে স্বচ্ছন্দ থাকেন, এমনকী উঠতি টিভি-নায়িকাদের বাড়ি লক্ষ্মীপুজো-সন্তোষী মায়ের পুজোতেও অংশ নিতে যান— তাঁকে বণিকসভার কোনও অনুষ্ঠানে বড় একটা দেখাই যায় না। গেলেও অতি দ্রুত চলে আসার চেষ্টা থাকে।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা উদ্বোধনী আসরে উপস্থিত থাকবেন, শুধু সেই জন্য গত বছর সিআইআই-এর শিল্প সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল টাউন হলে। ঘটনাচক্রে সে দিনই সুচিত্রা সেন মারা যান। আর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুচিত্রার অন্ত্যেষ্টিতে ব্যস্ত মুখ্যমন্ত্রী একটু সময় বের করে টাউন হলে যেতে পারেননি। গিয়েছিলেন অমিত মিত্র। মোবাইল ফোন মারফত নিজের বক্তব্য মঞ্চে পৌঁছে দিয়েছিলেন মমতা। সিআইআই-এর এক সদস্য সে দিন বলেছিলেন, “শিল্পমহলের কাছে বার্তাটা ভাল গেল না। মুখ্যমন্ত্রী আধ ঘণ্টা সময়ও বের করতে পারলেন না!” পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় এসেও ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়েছে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েলকে। মমতার সময় হয়নি।

তিন বছর ধরে ‘সংস্কৃতিপ্রেমী’ এমনই এক মমতাকেই বার বার দেখেছেন পশ্চিমবঙ্গবাসী। শুক্রবার সন্ধ্যাটিও তার ব্যতিক্রম হল না। নেতাজি ইন্ডোরে কলকাতা পুলিশের কর্মী ও তাঁদের পরিবারবর্গের জন্য আয়োজিত বিচিত্রানুষ্ঠান ‘জয় হে’-র আসরে কখনও মঞ্চে, কখনও বা দর্শকাসনে তারকাদের আলো মেখে খোশমেজাজে সন্ধেটা কাটালেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর পাশে কখনও শাহরুখ, কখনও বিপাশা, কখনও দেব, কখনও জিৎ-রচনা বা টালিগঞ্জের অন্য কেউ।

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতো শিল্প-বিরোধী আন্দোলনের হাত ধরে মুখ্যমন্ত্রিত্বের পথে উত্থান ঘটেছিল মমতার। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরেই বেলভেডিয়ার ক্লাবে শিল্পমহলের সঙ্গে দেখা করে ইতিবাচক বার্তা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। শিল্পপতিরাও তখন এক জন মুখ্যমন্ত্রীর ঘরোয়া আটপৌরে ব্যবহারে মুগ্ধ হন। কিন্তু ক্রমশ দেখা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী শিল্পের নিজস্ব সংজ্ঞা স্থির করে নিয়ে শিল্পপতিদের চেয়ে শিল্পীদের প্রতি বেশি মনোযোগ দিয়ে চলেছেন। প্রত্যেক বছর পুজোর পরে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে শিল্পপতিদের জন্য একটি বিজয়া সম্মেলনের আয়োজন করা হয় বটে। কিন্তু সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে শিল্পপতিদের আলাপ বিশেষ হয় না। মমতার শুভেচ্ছা-ভাষণের পরে শিল্পপতিরা নিজেদের মতো কিছুটা সময় কাটিয়ে চলে যান। আর মুখ্যমন্ত্রী গোল টেবিলে খোশগল্পে মেতে যান টলিউড-টেলিউডের সঙ্গে। প্রকাশ্যে না-বললেও মুখ্যমন্ত্রীর এই মানসিকতা শিল্পপতি ও বণিকমহলে অন্দরে আলোচনার বিষয়।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শাহরুখ খান। —নিজস্ব চিত্র

মমতা শিল্পপতিদের এড়িয়ে চলেন, এই সমালোচনা অবশ্য মানতে নারাজ তৃণমূল নেতারা। শিল্প যে মুখ্যমন্ত্রীর অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে, তা বোঝাতে কলকাতা, হলদিয়ার ‘বেঙ্গল লিডস’ বা নয়াদিল্লি, মুম্বইয়ের শিল্প সম্মেলনের উদাহরণ তুলে ধরছেন তাঁরা। বলছেন, শিল্প টানতেই তো আর ক’দিন পরে সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন মমতা।

কিন্তু রুপোলি পর্দার নায়ক-নায়িকাদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর বাড়তি টানের কথা অস্বীকার করতে পারছে না তৃণমূল শিবিরও। প্রশ্ন হল, সেটা কি তাঁর নিছক সংস্কৃতি-আসক্তি?

তাঁর পূর্বসুরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও নন্দনে সন্ধে কাটাতে স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। তা নিয়ে অনেক সময় কেউ কেউ বিরূপ প্রশ্নও তুলেছেন। কিন্তু ঘটনা হল, মায়াকভস্কি, মার্কেজের অনুরাগী এবং দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্রের নিয়মিত দর্শক হিসেবে গোড়া থেকেই পরিচিতি ছিল বুদ্ধদেবের। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তাঁকে এ ক্ষেত্রে নতুন করে কোনও অভিধা অর্জন করতে হয়নি। মমতার ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা ঘটেনি। মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “একটা সময়ে মমতাকে নানা ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছে। তাই সংস্কৃতি-জগতের সঙ্গে তাঁর এই মেলামেশায় হয়তো কিছুটা নিজেকে প্রমাণ করার উদ্যোগ রয়েছে।” সরকারি পোস্টারে মুখ্যমন্ত্রীর নিজের কবিতার বা ছবির প্রচার থেকে শুরু করে কারণে-অকারণে শিল্পীদের সঙ্গে সময় কাটানোর মধ্যেও মমতার ‘বৈদগ্ধ্য’ প্রকাশের কিছুটা চেষ্টা দেখতে পান কেউ কেউ।

ইতিহাস জানে, বহু শাসকই মোসাহেব পরিবৃত্ত হয়ে থাকতে ভালবেসেছেন। যে কোনও মানুষেরই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে। শিল্পপতিদের তুলনায় অভিনেতা-গায়ক-শিল্পীদের সান্নিধ্যই যে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর বেশি পছন্দের তাতে তাই আপাত ভাবে হয়তো বলার কিছু নেই। কিন্তু মমতার ক্ষেত্রে এই প্রবণতার অন্য একটি দিক দেখছেন মনস্তত্ত্ববিদেরা। তাঁদের কারও কারও মত, মুখ্যমন্ত্রী মমতা তাঁদের সঙ্গেই থাকতে ভালবাসেন, যাঁরা তাঁকে কোনও রকম সমালোচনার চোখে দেখবেন না। উপরন্তু অভিনেতা-অভিনেত্রী-নায়ক-গায়কদের জনপ্রিয়তাকে তাঁর নিজের রাজনৈতিক প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারবেন। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়, যখন মমতা তৃণমূলের রাজনৈতিক সমাবেশে দলের বড় বড় নেতাদের বাদ দিয়ে প্রবীণ-নবীন নায়ক-গায়ক-লেখক-শিল্পীদের বক্তৃতা দিতে ডাকেন।

নানা ধরনের সরকারি পুরস্কার চালু করে এবং কমিটির সদস্যপদ বিতরণ করে এই শিল্পী-লেখকদের কাছে টেনে রাখার ব্যবস্থা করেছেন মমতা। যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকেন, সঙ্গে ঘোরেন, তাঁর দলে নাম লেখান, বিভিন্ন পুরস্কারের তালিকায় মূলত তাঁদেরই জয়জয়কার। যাঁরা পুরস্কার পেয়ে যান, তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় অকৃপণ হন। যাঁরা প্রত্যাশী, তাঁরাও মুখ্যমন্ত্রীর ‘নেকনজরে’ থাকার চেষ্টা করেন। ফলে তালিকা ছোট হয় না। সেই পথ বেয়েই এগিয়ে এসেছেন ইন্দ্রনীল, রুদ্রনীল, শ্রীকান্ত মোহতারা। তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় তারকাদের ছড়াছড়ি। রাজনৈতিক সমাবেশে মমতা নিজে স্লোগান তুলেছেন ‘দেব আমাদের, শুভশ্রীও!’

মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, বণিকসভার বেশির ভাগ অনুষ্ঠানই পাঁচতারা হোটেলে হয়। তাই মমতা সচরাচর সেখানে যান না। তাঁর বহিরঙ্গের নীল পাড় সাদা শাড়ি, হাওয়াই চটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজের সাধারণ লোক-সুলভ ইমেজ জিইয়ে রাখতেই পাঁচতারা হোটেলের সঙ্গে এই দূরত্ব বজায় রাখেন মুখ্যমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে বণিকসভার এক কর্তার মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী কেন যেতে চান না, সে প্রশ্নের উত্তর নেই। অতিথিদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে অধিকাংশ শিল্প সম্মেলন হোটেলে আয়োজিত হয়। হোটেল কেন অচ্ছুৎ হতে যাবে, তার কোনও ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই।”

ঘটনা হল, শিল্প ও বণিকসভার অনুষ্ঠান এড়িয়ে গেলেও চলচ্চিত্র উৎসবের নৈশভোজে কিন্তু শহরের ঐতিহ্যপূর্ণ পাঁচতারা হোটেলে বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটাতে পারেন মমতা। কারণ সেখানে তাঁকে ঘিরে থাকেন তাঁরা, যাঁদের সান্নিধ্য তাঁর কাছে ‘প্রকৃত শিল্পের’ বার্তা বহন করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE