প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর
বাংলায় শিল্পের পরিবেশ নিয়ে এ রাজ্যের বিরোধী থেকে ভিন্ রাজ্যের শিল্পপতি— সমালোচনায় মুখর হয়েছেন অনেকেই। রাজ্যের বণিক মহলেরও অনেকে এখানে শিল্পের পরিবেশ নিয়ে বিশেষ আশার আলো দেখতে পাননি। এ বার রাজ্যের শিল্প-পরিবেশ নিয়ে সরাসরি মুখ খুললেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর। মঙ্গলবার একটি মামলার শুনানি শেষে এজলাসে বসেই পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে কড়া মন্তব্য করেন তিনি। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি ‘অনধিকার চর্চা’ করেছেন কি না, সেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে শাসক দল।
পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের পরিবেশের জটিলতা বোঝাতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি এ দিন তুলনা টেনেছেন দক্ষিণ ভারতের তেলঙ্গানার সঙ্গে। প্রধান বিচারপতি এ দিন মন্তব্য করেন, ‘‘তেলঙ্গানায় কেউ বিনিয়োগ করতে গেলে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর থেকে বিমানবন্দরে পৌঁছে বিনিয়োগকারীকে রীতিমতো এসকর্ট করে নিয়ে যাওয়া হয়! একটি মাত্র দরখাস্ত করতে হয় বিনিয়োগকারীকে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে সবটা দেখেন। ২১ দিনের মধ্যে কাজ হয়ে যায়। কারও কাজ আগে, কারও কাজ পরে— এমন হয় না!’’
বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থা এমপিএসের আমানতকারীদের টাকা ফেরত সংক্রান্ত জনস্বার্থ মামলার শুনানি ছিল এ দিন। ওই সংস্থার সব আমানতকারী যাতে দ্রুত টাকা ফেরত পান, প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ সে ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে। এই মামলার সূত্রেই কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা সেবি-র আইনজীবী এ দিন আদালতে জানান, অন্য একটি অর্থলগ্নি সংস্থার আমানতকারীদের টাকা ফেরতের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্টের বিচারপতি নাদিরা পাথেরিয়া। কিন্তু আদালতের নির্দেশে সেই অর্থলগ্নি সংস্থার জমিজায়গা বিক্রি করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, কেউ সেই জমি কিনতে এগিয়ে আসছেন না। প্রায় সব জমি আইনি জটিলতায় আটকে। এই সূত্রেই প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘এই পরিবেশে এখানে কোটি কোটি টাকা কে বিনিয়োগ করবে! কেরল, কর্নাটক থেকেও কেউ আসবে না। কারণ, আমি জানি। মানসিকতা....।’’
বস্তুত, চেল্লুর যা বলেছেন, তা মোটেও অভিনব নয়। গত চার বছরে রাজ্যে শিল্পের পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে একই সমালোচনা শোনা গিয়েছে। একে তো রাজ্য সরকার মুখে শিল্প নিয়ে আগ্রহ দেখালেও কার্যক্ষেত্রে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে ‘না’ বলে দিয়েছে! শিল্পের জন্য তাদের সম্বল জমিব্যাঙ্ক, যা তারা বারবার দেখিয়ে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। সম্প্রতি রাজ্যে ৬টি স্মার্ট সিটি গড়ার জমিও ওই জমিব্যাঙ্ক থেকেই নেওয়ার কথা বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সমস্যা হল, জমিব্যাঙ্কের জমি যেখানে, সেখানে সর্বত্র যে শিল্পের উপযুক্ত পরিকাঠামো আছে— তা নয়। আবার জমিব্যাঙ্ক থেকে এক লপ্তে অনেকটা জমি পাওয়াও দুষ্কর। এ সবের পাশাপাশিই আছে জমি কিনতে গিয়ে শিল্পপতিদের জমি-মাফিয়ার খপ্পরে পড়া, সিন্ডিকেট ও তোলাবাজির দাপট এবং তার জেরে আইনশৃঙ্খলার শোচনীয় হাল। এ সব নিয়ে চর্চাও হয়েছে বিস্তর। কিন্তু এ বারে প্রধান বিচারপতির মুখ থেকে এসেছে বলেই সমালোচনার অভিঘাতও বেশি। চেল্লুরের সমালোচনার সঙ্গে নীতিগত ভাবে একমত হয়েও রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএম নেতৃত্বও ঘরোয়া আলাপচারিতায় মেনেছেন, প্রধান বিচারপতি অন্য মামলার শুনানিতে শিল্পায়ন নিয়ে এমন মন্তব্য করবেন, এটা রেওয়াজ নয়। এবং ঠিক এই কথাই বলছেন শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বও। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন প্রধান বিচারপতির এক্তিয়ার নিয়ে।
তৃণমূলের মহাসচিব এবং রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, ‘‘প্রধান বিচারপতি ঠিক কী বলেছেন, না জেনে মন্তব্য করা উচিত নয়। যদি এমন কথা বলে থাকেন, তা হলে আমরা ব্যথিতই হয়েছি!’’ তাঁর বক্তব্য, এ থেকে এমন প্রশ্নও উঠতে পারে যে, এটা কি অনধিকার চর্চা নয়? এর মধ্যে প্রাদেশিকতার সুর আছে কি না, সে প্রশ্নও উঠতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
প্রধান বিচারপতির কটাক্ষের কথা জেনে এ দিন বিধানসভায় স্বাস্থ্য বাজেটের আলোচনায় বিষয়টি উত্থাপন করেন বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য। পরে জবাবি বক্তৃতায় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী তথা আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বিচারপতিদের কথা টেনে আনার জন্য শমীককে পাল্টা কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘বিনিয়োগ নয়, পরিষেবায় আত্মনিয়োগে আমরা আগ্রহী।’’ পরে বিধানসভার অলিন্দে শমীক বলেন, ‘‘বাংলার মানুষের লজ্জা যে, প্রধান বিচারপতিকে এমন কথা বলতে হচ্ছে! দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই বাস্তব।’’ কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, ‘‘সিঙ্গুরের ঘটনার পর থেকেই শিল্পপতিরা সংশয়ে রয়েছেন। যেখানে তাঁরা নিশ্চিন্ত, সেখানেই তাঁরা বিনিয়োগ করেন। রাজ্যে শিল্প আনতে চাইলে এই ‘সিঙ্গুর সিনড্রোম’ প্রথমে কাটাতে হবে।’’ সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য, ‘‘প্রধান বিচারপতি এখানে নিযুক্ত হয়ে এসেছেন, আবার চলেও যাবেন। যন্ত্রণায় থাকবেন বাংলার মানুষ!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy