E-Paper

বাজি-মহল্লায় শিশুদের বারুদ মাখা হাতেই জমে উঠেছে ব্যবসা

অবৈধ বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে সম্প্রতি মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অংশে ঘরে ঘরে যেন বিপদের কুটির শিল্প।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৩ ০৭:১৮
illegal fire crackers.

পরিবারের বড়রাই ছোটদের বাজির কারখানায় দিয়ে আসেন রোজগারের আশায়। ফাইল চিত্র।

জায়গা কেনার চেয়ে ভাড়ায় নেওয়ার খরচ বেশি এই তল্লাটে। ভরা মরসুমে এক-এক সময়ে পরিস্থিতি এমনও হয় যে, প্লাস্টিক পাতার জায়গাটুকুর হিসাবে বাড়ির উঠোন থেকে রান্নাঘর, পুকুরপাড় থেকে গোয়ালঘর— সবই ভাড়ায় দেওয়া হয় ব্যবসার জন্য। দোকান পাততে বাদ যায় না বড় রাস্তা থেকে গলিপথের জায়গাও। বাজি কিনতে আসা হয়েছে জানানোয় ভাড়ায় নেওয়া এমনই একটি উঠোনে দাঁড়ানো, সারা গায়ে বারুদ মাখা এক কিশোরী বলল, ‘‘বাবু বাড়ি নেই। বিয়ের অর্ডার নেওয়া এখন কয়েক দিন বন্ধ আছে। বোমা না বাজি লাগবে, লিখে দিয়ে যান। বাবু যোগাযোগ করে নেবেন।’’

সারা গায়ের এই অবস্থা! বছর চোদ্দোর মেয়েটি বলে, ‘‘বাজির কিছু অর্ডার নেওয়া ছিল। সেই কাজই আমাদের বন্ধুদের মিলে শেষ করতে হচ্ছে। বড়রা পুলিশের ভয়ে কয়েক দিন কাজে আসছেন না।’’ গত সোমবারই মহেশতলার পুটখালি মণ্ডলপাড়ার একটি অবৈধ বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। যার জেরে মৃত্যু হয় কারখানার মালিকের স্ত্রী, ছেলে এবং এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী কিশোরীর। সে কী কারণে ওই বাজি কারখানায় গিয়েছিল, তা স্পষ্ট নয়। তাকে দিয়েও বাজি তৈরির কাজ করানো হত কি না, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে নানা মহলে। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার চম্পাহাটির বেগমপুর, হারাল, সোলগলিয়া বা মহেশতলার নুঙ্গি, পুটখালি, বলরামপুরের মতো বেআইনি বাজি তৈরির জন্য কুখ্যাত জায়গাগুলিতে ঘুরে জানা গেল, ওই সমস্ত তল্লাটে বাজির কারবারে সারা বছর শিশুরাই অন্যতম সম্পদ। বিস্ফোরণের ঘটনার পরে পুলিশের ভয়ে বহু বাজি কারবারিই এই মুহূর্তে গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাঁরা সামনে না এলেও বাজির কারবার বন্ধ নেই। বহু কাজই চালানো হচ্ছে একদল শিশু-কিশোরদের দিয়ে। তাদের অনেকেই সারা বছর স্কুলে যায় স্রেফ মিড-ডে মিলের জন্য। তার পরেই সোজা বাজির কাজে।

প্রায় প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে আর্থিক অনটন। পরিবারের বড়রাই ছোটদের বাজির কারখানায় দিয়ে আসেন রোজগারের আশায়। কারখানার মালিকদের কাছেও এমন শিশু শ্রমিকের চাহিদা বেশি। বাজির কারবারে যুক্ত এক ব্যক্তি বললেন, ‘‘সাধারণ শ্রমিকদের নানা টালবাহানা রয়েছে। দিনে তিনশো থেকে পাঁচশো টাকা মজুরি দিতে হবে। তিন বেলা খাবারের টাকা অতিরিক্ত। সেই জায়গায় অধিকাংশ শিশু শ্রমিককে একশো চকলেটের হিসাবে মজুরি দিলেই খুশি।’’

জানা গেল, ওই সব এলাকায় শিশুদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি নির্দিষ্ট করা নেই। মজুরির হিসাবের মাপকাঠি ‘একশো’। ১০০টি চকলেট বোমা তৈরি করতে পারলে তবে হাতে আসে নগদ ২০ থেকে ২৫ টাকা। ১০০ রংমশাল তৈরি করলে মিলবে ৫০ টাকা। এমনই নিয়ম। বাজির কারিগরদের কথায়, ‘‘চার-পাঁচ ঘণ্টায় এক থেকে দেড় হাজার চকলেট বোমা তৈরি করে ফেলে কচিকাঁচারা। আর একটি সুবিধা হল, ওদের বিড়ির নেশা নেই। বাজি তৈরির সময়ে বিড়ির আগুনই বহু দুর্ঘটনার কারণ। শুধু বাজি তৈরিই নয়, শিশু শ্রমিকেরা যুক্ত পরের আরও অনেকগুলি ধাপে।’’ যার মধ্যে রয়েছে শব্দবাজি বিক্রি করা এবং তার ‘হোম ডেলিভারি’। ছোটদের অত তল্লাশি করা হয় না। পড়তে যাওয়ার নাম করে পড়ার ব্যাগে অনায়াসে বাজি ভরে নিয়ে সেগুলি গন্তব্যে পৌঁছে আসে ওরা।

বাজি এবং বারুদ শুকোনোর দায়িত্বেও থাকে কচিকাঁচারাই। ওই এলাকার এক বাজি কারিগরের কথায়, ‘‘যখন-তখন পুলিশ চলে আসতে পারে। ছোটরা থাকলে পুলিশের গাড়ি দেখেই খবর ছড়িয়ে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে মাদুর গুটিয়ে বাজি বা মশলা সরিয়ে ফেলা যাবে।’’ আর হাতেনাতে ধরা পড়লে? এক কারখানার মালিকের সাফ উত্তর, ‘‘মালমশলা নিয়ে যায় পুলিশ। ছোটদের তো ধরে না।’’

বিস্ফোরণস্থল থেকে বেরিয়ে আসার মুখেই চোখে পড়ে এক নাবালিকা। মাদুরে বাজি শুকোতে দিয়েছে সে। কথায় কথায় মেয়েটি জানায়, তার বাবা দিনমজুরের কাজ করেন। মা কলকাতায় পরিচারিকার কাজে যুক্ত। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে-ই বড়। বাজির কাজ করেই বোনকে বিয়ে দেবে বলে ঠিক করেছে সে। মেয়েটি বলল, ‘‘এখন মশলা শুকোনোর জন্য দিনে ৫০ টাকা মজুরি পাই। কারখানা থেকে চকলেটের প্যাকেট কাস্টমারকে বিক্রি করতে পারলেই ১০ টাকা কমিশন। এর পরে কারখানায় বাজি তৈরির কাজ তো আছেই। যত বেশি কাজ, তত বেশি টাকা!’’ এ ভাবেই কচি হাত রাসায়নিক মশলায় ধূসর হয়ে উঠতে দেরি লাগে না। (চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Illegal Fireworks Child Labour

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy