প্রেক্ষাগৃহ নিজেই এখন প্রদর্শনীর অঙ্গ। — নিজস্ব চিত্র
কেউ ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে। কেউ ইতিমধ্যেই ধ্বংসস্তূপ। খুব সৌভাগ্যবান যারা, তাদের কারও কারও নতুন খোলনলচে জুটছে। বাকিদের গুঁড়িয়ে দিয়ে মাথা তুলছে নতুন নির্মাণ। ওরা এ শহরের সাবেক সিনেমা হল। মাল্টিপ্লেক্স জমানায় যাদের ডাকা হচ্ছে সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার বলে।
মৃত সময়ের খণ্ডহরও কি উস্কে দিতে পারে শিল্পের নতুন ভাবনা? সম্প্রতি সম্ভাবনাটা ছুড়ে দিয়ে গেল এন্টালির ‘জেম’ সিনেমা হলকে ব্যবহার করে গড়ে ওঠা একটি ইনস্টলেশন-প্রদর্শনী।
ঝাঁ চকচকে চৌখুপি গ্যালারি ছেড়ে বেরিয়ে নানা ধরনের পরিসরকে আধার হিসেবে কাজে লাগানোর ধারা ইনস্টলেশন আর্ট-এ নতুন নয়। ছয়-সাতের দশক থেকে পশ্চিমে জনপ্রিয় হতে শুরু করে এই শিল্পধারা। নয়ের দশক থেকে রীতিমতো জোয়ার এসেছে তাতে। ইনস্টলেশন আর্ট-এ নানা ধরনের মাধ্যম মিলিয়ে দেওয়া হয়। এবং অনেক সময়েই সেটা একটি নির্দিষ্ট সাইট বা পরিসরের উপরে নির্ভরশীল হয়। সেটা গ্যালারিও হতে পারে, আবার কোনও রাস্তার ধার-পুরনো বাড়ি-খোলা মাঠ বা যা কিছুই হতে পারে। ২০১৪ সালে যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শতবর্ষ উপলক্ষে টাওয়ার অব লন্ডনের পরিখায় লাল পপি ফুলের গাছ পুঁতে একটি ইনস্টলেশন হয়েছিল। যার নাম ছিল, ‘ব্লাড সোয়েপ্ট ল্যান্ড অ্যান্ড সিজ অব রেড’। শিল্পী ক্রিস্টো এবং জাঁ ক্লদ আবার গত বছর তাঁদের ‘দ্য ফ্লোটিং পিয়ার্স’ নামে একটি ইনস্টলেশনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন ইতালির একটি হ্রদকে।
কলকাতা সেখানে পা রাখল প্রায় ফসিল হয়ে যাওয়া একটি প্রেক্ষাগৃহে। আয়োজকদের দাবি, শহরে এমন উদ্যোগ এই প্রথম।
১৯৬৯ সালে তৈরি হওয়া জেম সিনেমা হলটি ১৯৯৮ সালে বন্ধ হয়ে যায় আর পাঁচটা সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটারের মতোই। অযত্নে এবং অবহেলায় নষ্ট হতে হতে ২০০৫ সালে আগুন লেগে যায় তাতে। বলতে গেলে, কাঠামোটুকু ছাড়া কিছুই বাকি নেই এখন। ঢুকতে গেলেই চোখে পড়ে প্রায় ঝুলে পড়া ছাদ, চটলা ওঠা দেওয়াল। মুখে এসে লাগে মাকড়সার জাল। আলো-আঁধারি ঘরে উঁকি মেরে যায় চামচিকে। ন্যূনতম ঝাড়পোঁছটুকুও না-করে এই ভাঙচুরটাকেই নিজেদের রসদ করে নিলেন শহরের সাতাশ জন এবং এডিনবরা থেকে আসা এক শিল্পী। মধুজা মুখোপাধ্যায়ের ‘শোলে’ যেমন। ঝুরঝুরে সিনেমা হলের ততোধিক ঝুরঝুরে ব্যালকনিতে খড়খড়ে দেওয়ালে প্রোজেক্টর ছায়া ফেলছে ছবির কিছু দৃশ্যের। আর ব্যালকনির মাথা-ভাঙা প্রতিটা চেয়ারে নাম লেখা রয়েছে ছবির চরিত্রগুলির কাছাকাছি একটা করে নাম। তরুণ সিনেমাটোগ্রাফার উৎসব চট্টোপাধ্যায়ের তেরো মিনিটের ছবির পুরো শ্যুটিংই হয়েছে হলের অন্দরে। তার প্রদর্শন হচ্ছে একটি ভাঙাচোরা, চটলা-ওঠা দেওয়ালের কোণে। সামনেই ডাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে ভাঙা চেয়ার, ফাটা বেসিন, একরাশ পুরনো ফিল্মের রিল, কাঠের টুকরো, রাবিশ।
আরও পড়ুন:
প্রদর্শনীর কিউরেটর মানস আচার্যের কথায়, ‘‘ঝাঁ চকচকে গ্যালারি থেকে শিল্পকে বার করে দৈনন্দিনের মধ্যে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টাতেই অভিনব আয়োজন।’’ একমত হলেন নাট্য ও চিত্রপরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ও। প্রদর্শনীটি নিজে দেখেছেন তিনি। বললেন, ‘‘যে কোনও শিল্পমাধ্যমই একটা সময় পরে থমকে যায়। তখন নতুন পথ খুঁজে শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই চ্যালেঞ্জ। ভাঙা সিনেমা হলকে এ ভাবে কাজে লাগিয়ে যে নতুন সম্ভাবনার দিকটি খুলে গেল, তা অভিবাদনযোগ্য।’’
সিনেমা হলের ঠিক উল্টো দিকেই বহু বছর ধরে ছোট একটা খাবারের দোকান চালান স্বপন পোদ্দার। ৬৪ বছরের স্বপনবাবুর কাছে এই প্রদর্শনী স্বপ্নের মতো। ‘‘এক সময় নতুন সিনেমা রিলিজ করলে পা ফেলার জায়গা থাকত না হলের সামনে। সেই অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যেতে দেখলাম হলটাকে। কখনও ভাবিনি আবার খুলবে হলের গেট, আবার পা পড়বে দর্শকদের।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy