Advertisement
E-Paper

মমতার নির্দেশে কড়া পুলিশ, কাঁপুনি দলেই

কান টানলে মাথা আসে! বাড়ির মালিক, কিংবা প্রোমোটারকে সরাসরি হুমকি নয়। তাঁদের কাছ থেকে তোলা আদায় করতে ইদানীং বাড়ি তৈরির কাজে যুক্ত ঠিকাদার বা শ্রমিকদের ভয় দেখিয়ে, মারধর করে কাজ বন্ধ করার কৌশলই নিয়েছেন সিন্ডিকেটের দাদা-দিদিরা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৬ ০৪:২৬
কড়া মুখ্যমন্ত্রী।

কড়া মুখ্যমন্ত্রী।

কান টানলে মাথা আসে!

বাড়ির মালিক, কিংবা প্রোমোটারকে সরাসরি হুমকি নয়। তাঁদের কাছ থেকে তোলা আদায় করতে ইদানীং বাড়ি তৈরির কাজে যুক্ত ঠিকাদার বা শ্রমিকদের ভয় দেখিয়ে, মারধর করে কাজ বন্ধ করার কৌশলই নিয়েছেন সিন্ডিকেটের দাদা-দিদিরা। আসলে সরকারে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর প্রথম দিন থেকেই সিন্ডিকেটরাজ, তোলাবাজি-সহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে পুলিশের দিক থেকেও চাপ আসছিল। তাই এই কৌশল বদল।

কিন্তু রাজারহাট-গোপালপুরের সিন্ডিকেট এলাকায় সুনীল বিশ্বাসের মতো কেউ সাহস দেখিয়ে এগিয়ে এলে সেই নতুন কৌশলই বা কত দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব?

কেষ্টপুরের রবীন্দ্রপল্লির বাসিন্দা বৃদ্ধ সুনীলবাবু বাড়ির কাজে হাত দিয়েছেন জেনে তাঁকে হুমকি দিয়ে এসেছিল তোলাবাজরা। তাদের মুখে ছিল তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ দোলা সেনের নাম। এমনটা হলে সাধারণ ভাবে বাড়ির মালিক বা প্রোমোটারের মাথায় হাত পড়ে। কাজ শেষ করার তাগিদে তাঁকে ছুটতে হয় নেতা-নেত্রীর কাছে। রফায় আসার জন্য। সেই রফাও সহজে হয় না, জানাচ্ছেন এক প্রোমোটার। গোড়ায় নেতা বা নেত্রী দেখাই করেন না। দিনের পর দিন ঘুরে নাজেহাল হয়ে শেষ পর্যন্ত তোলা দিতে রাজি হয়ে যান মালিক বা প্রোমোটার। তখন শুরু হয় টাকার অঙ্ক নিয়ে দরাদরি।

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী সুনীলবাবু কিন্তু মাথা নত করেননি। সাহস করে সরাসরি নালিশ ঠুকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। তার পর মমতার হস্তক্ষেপে, পুলিশি নিরাপত্তায় বাড়ির কাজ শেষ করেন বৃদ্ধ। বেগতিক বুঝে তোলাবাজরাও আর ওই পথ মাড়ায়নি।

সুনীলবাবুকে হুমকি দেওয়ার ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অবশ্য স্বীকার করেননি দোলা সেন। তবে অন্য একটি তোলাবাজির ঘটনায় মঙ্গলবার বিধাননগরের তৃণমূল কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার হওয়ার পর বুধবার মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তিনি বলেছেন, ‘‘তৃণমূলে আমাদের কারও চাকরি পাকা নয়। ফাউল হলেই দলনেত্রীর কাছে হলুদ কার্ড বা লাল কার্ড দেখতে হতে পারে। তাই আমরা যত বড় নেতাই হই না কেন, জানবেন সব সময় খুব টেনশনে থাকি। এই আছি, আবার এই নেই। কখন বাদ চলে যাব, ঠিক নেই।”

বিধাননগরের বিডি ব্লকের বাসিন্দা সন্তোষ লোধের অভিযোগের ভিত্তিতে ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর অনিন্দ্যকে মঙ্গলবার গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু রবীন্দ্রপল্লির ঘটনায় দোলার নামে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। ফলে পুলিশও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। তবে নবান্নের কড়া নির্দেশে সিন্ডিকেটরাজের দমনে পুলিশ যখন কড়া হতে শুরু করেছে, তখন নেপথ্যচারীদের কাছেও প্রয়োজনীয় বার্তা চলে গিয়েছে বলেই তৃণমূল সূত্রে দাবি।

বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের এক শীর্ষকর্তা এ দিন বলেন, ‘‘নির্দেশ এসেছে একেবারে উপরতলা থেকে। সিন্ডিকেটের নামে তোলাবাজি, জুলুমের অভিযোগে প্রায় ৮০ জনের নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ২০ জুন থেকে এ পর্যন্ত তাদের মধ্যে ৩৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতদের মধ্যে রুইস মণ্ডল, সুশান্ত সর্দার, রঞ্জিত দাস ওরফে ব্যস্ত বাপি, ক্রান্তি মজুমদারের মতো বড় মাপের তোলাবাজও রয়েছে।’’ তিনি জানান, ধৃতেরা কোনও-না-কোনও নেতা-নেত্রীর ছত্রচ্ছায়ায় রয়েছে। তাদের ছাড়াতে থানায় ও উচ্চপদস্থ অফিসারদের কাছে প্রভাবশালী কয়েক জনের ফোনও এসেছে। কিন্তু নির্দেশ যে হেতু নবান্নের, তাই পুলিশ কোনও ফোনকেই আমল দেয়নি।

কিন্তু মাথাদের বাইরে রেখে সিন্ডিকেটরাজের বিরুদ্ধে অভিযান কতটা সফল হবে সেই প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। তাঁরা মনে করাচ্ছেন, খোদ মুখ্যমন্ত্রীই সিন্ডিকেটকে বৈধ ব্যবসা আখ্যা দিয়েছিলেন। এবং ভোটের আগে বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্তবলেছিলেন, ‘‘এরা (সিন্ডিকেটের লোকেরা) না খেয়ে মরলে সরকার পড়ে যাবে।’’ যার উত্তরে তৃণমূল শিবির পাল্টা বলছে, সিন্ডিকেট জন্ম নিয়েছিল বাম আমলেই। আর সিন্ডিকেটের নামে জুলুমবাজিকে যে বরদাস্ত করা হবে না, সেটা বারবারই স্পষ্ট করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই কারণেই শাসক দলের কাউন্সিলরকে গ্রেফতার করতেও পিছপা হয়নি পুলিশ।

কিন্তু বিরোধীদের দাবি, অনিন্দ্যর নামে এর আগেও অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সল্টলেকের এক বাসিন্দা তাঁর উপরে তোলাবাজির ঘটনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কানে তোলার পরে এবং হাসিনা বিষয়টি মমতাকে জানানোর পরেই অনিন্দ্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যার অর্থ, খুব উপরতলার যোগাযোগ না-থাকলে সিন্ডিকেটরাজের হাত থেকে রেহাই পাওয়া অসম্ভব।

বাম আমলে জন্ম হলেও সিন্ডিকেটের রমরমা যে তৃণমূল আমলেই সল্টলেক থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে, তা কবুল করেছেন প্রশাসনের কর্তারাও। আর সেই রমরমার পিছনে মদত রয়েছে শাসক দলের নেতা নেত্রীর। যেমন, রাজারহাট-গোপালপুর এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, একদা এলাকার স্বঘোষিত যুব নেতা বিশ্বজিৎ (বাবাই) বিশ্বাস ছিলেন স্থানীয় বিধায়ক তথা মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু ও দোলা সেনের ঘনিষ্ঠ। তখন তাঁকে পুলিশ ছুঁতে পারেনি। একটি খুনের ঘটনার পর থেকে বাবাই এখনও ফেরার। এলাকায় এখন দাপাচ্ছে সাধন সরকার নামে এক যুবক। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে পুলিশ নিজেই মামলা করেছে। তাঁরও গাঁটছড়া পূর্ণেন্দু-দোলার সঙ্গে। তাকেও তাই ছুঁতে পারছে না পুলিশ।

এখন নবান্নের কড়া নির্দেশের পরে অবস্থা কি পাল্টাবে? উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের বক্তব্য, ‘‘লিখিত অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়েছে। এ বার দলীয় স্তরেও অনিন্দ্যর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় সুশাসন ও সুবিচার— দুই-ই পাওয়া যায়।’’ একদা খোলাখুলি সিন্ডিকেটের পাশে দাঁড়িয়ে বিতর্কের ঝড় তোলা সব্যসাচী দত্তও একই সুরে বলেছেন, ‘‘এত দিন কোনও লিখিত অভিযোগ হাতে পাইনি। এ বার তা পাওয়ার পরেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে, আমরা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নই।’’ আর বিধাননগরের তৃণমূল বিধায়ক সুজিত বসুর মন্তব্য, ‘‘দলের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, কেউ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবে না। ফলে, পুলিশ যা করছে, ঠিক করছে।’’

police Mamata Banerjee extortion
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy