জঙ্গি সন্দেহে ধৃত বাংলাদেশি শাব রাডির পশ্চিমবঙ্গের দু’জায়গায় ভোটার তালিকায় নাম থাকার ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে তাঁদের। অন্তত এমনই দাবি করছেন মুর্শিদাবাদের নওদা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সইদুল ইসলাম। তাঁর বক্তব্য, শাব কয়েক বছর এখানে থেকে স্থানীয় বাসিন্দা পরিচয় দিয়ে ভোটার-তালিকায় নাম তুলেছিল। সন্দেহ না করে নাগরিক শংসাপত্র পেতে সুপারিশ করেছিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য। সইদুল বলছিলেন, “আমাদের অনেক সতর্ক থাকতে হবে।”
সতর্কতার আর একটা কারণ আগামী বছরে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপের তৃণমূল বিধায়ক মন্টুরাম পাখিরার দাবি, কাকদ্বীপের তিনটি পঞ্চায়েত এলাকায় ভোটার সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি এলাকার প্রায় ছ’হাজার ভোটারের ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি প্রশাসনের দ্বারস্থ হন। তাঁর অভিযোগ, বাংলাদেশ থেকে আসা মৎস্যজীবীদের একাংশ চক্রের মাধ্যমে স্থায়ী বাসিন্দার শংসাপত্র, আধার ও রেশন কার্ড সংগ্রহ করে অবৈধ ভাবে ভোটার তালিকায় নাম তুলেছেন। টাকার বিনিময়ে সরকারি কর্মীদের একাংশ ওই কাজে সহায়তা করেছেন। একই অভিযোগ বিরোধী দলনেতা বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীরও। তবে স্থানীয় প্রশাসন অভিযোগ মানেনি।
বিজেপির অভিযোগ, জাল ভোটার বা আধার কার্ড তৈরির চক্রের দালালদের অধিকাংশ তৃণমূল-আশ্রিত। পক্ষান্তরে, তৃণমূলের একাংশের দাবি, সীমান্তে বিএসএফের নজরদারি ঢিলেঢালা বলে বাংলাদেশি হিন্দুরা এ দেশে বেআইনি ভাবে আসার পরে, বিজেপির মদতে তাঁদের ভোটার কার্ড হচ্ছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বনগাঁর বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের মন্তব্যে সেই শরণার্থী-অনুপ্রবেশকারী রাজনীতির ইঙ্গিত। তিনি বলেন, “যাঁরা উদ্বাস্তু শরণার্থী, তাঁদের কেন্দ্রীয় সরকার এ দেশ থেকে তাড়াবে না। কিন্তু যাঁরা বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু এবং এ দেশে অনুপ্রবেশকারী, তাঁরা যদি বেআইনি ভাবে ভারতীয় আধার কার্ড, ভোটার কার্ড-সহ ভারতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার পদক্ষেপ করছে, করবে।” পক্ষান্তরে, তৃণমূলের মথুরাপুরের সাংসদ তথা দলের ভোটার স্ক্রুটিনি কমিটির রাজ্য স্তরের সদস্য বাপি হালদার বলেন, “যদি কেউ অবৈধ ভাবে কিছু করে থাকে, প্রশাসন আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। এতে আমাদের দলের কেউ যুক্ত থাকলেও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।”
তবে তাঁর দল মালদহের লাভলি খাতুনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ালেও, তাঁর বিরুদ্ধে ঠিক কী ব্যবস্থা নিয়েছে, স্পষ্ট নয়। হরিশ্চন্দ্রপুরের রশিদাবাদ পঞ্চায়েতে বাড়ি লাভলির। তবে বংশপরিচয়ের শংসাপত্রের (ওয়ারিশ সার্টিফিকেট) জন্য দ্বারস্থ হন প্রতিবেশী কুশিদা পঞ্চায়েতের। জানা গিয়েছে, পঞ্চায়েত সদস্যের সঙ্গে যোগসাজশ করে তা জোগাড় করে, সেই সূত্রে ভোটার কার্ডে নাম তোলেন। পরে তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধানও হন। গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে প্রধান পদ থেকে অপসারণ করে প্রশাসন। এর পরেই লাভলির নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রকাশ্যে আসে তাঁর ভুয়ো ভোটার কার্ড তৈরির ঘটনা।
মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক রাজর্ষি মিত্র জানান, ভোটার তালিকায় নাম তোলা এবং নাম বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে শুনানি অপরিহার্য। আবেদনকারীর নথিপত্র নিয়ে প্রশাসন শুনানি করবে। তার পরে, সেই আবেদনের নিষ্পত্তি করা হবে। তিনি বলেন, “শুনানি যাতে হয়, সেই নজরদারি চালাচ্ছি।” তা ছাড়া, রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের ওয়েবসাইটে প্রধানদের অনলাইনে শংসাপত্র দেওয়ার সংস্থান রয়েছে। প্রধানেরা তাঁদের মোবাইলের ‘ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড’ (ওটিপি)-এর মাধ্যমে বাসিন্দাদের শংসাপত্র দেবেন। ভবিষ্যতে জালিয়াতি ধরা পড়লে, প্রধান জবাবদিহি করবেন।
জাতীয় নির্বাচন কমিশনের এক কর্তা জানান, জাল ভোটার চিহ্নিত করতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, ‘ফরেনার্স রিজিয়োনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস’ (এফআরআরও) এবং জাতীয় নির্বাচন কমিশন একযোগে কাজ করছে। তবে কমিশনের হয়ে স্থানীয় স্তরে ভোটার কার্ড সংক্রান্ত কাজ করেন রাজ্যের আধিকারিকেরা। কমিশন স্পষ্ট করে দিয়েছে, কোনও আধিকারিকের গাফিলতি প্রমাণিত হলে, দরকারে হবে ফৌজদারি মামলা। কমিশনের লক্ষ্য, নির্ভুল এবং ত্রুটিমুক্ত ভোটার তালিকা। বিধানসভা ভোটের আগে সেই কাজ কতটা হয়, তা অবশ্য সময় বলবে।
(শেষ)
তথ্য অনুসন্ধানে: নমিতেশ ঘোষ, সীমান্ত মৈত্র, সুস্মিত হালদার, সামসুদ্দিন বিশ্বাস, সুজাউদ্দিন বিশ্বাস, অভিজিৎ সাহা, সমরেশ মণ্ডল।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)