Advertisement
১১ মে ২০২৪
Dilip Ghosh

কোনও কিছুই ঠিক নেই, রাজ্যে অমানবিক পরিস্থিতি চলছে: দিলীপ ঘোষ

রাজ্যের অবস্থা একেবারেই ঠিক নেই, গোটা রাজ্যে একটা অমানবিক পরিস্থিতি চলছে— দাবি রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষের। এই পরিস্থিতিকে তিনি কী চোখে দেখছেন, বিশদে তা ব্যাখ্যা করলেন মেদিনীপুরের সাংসদ।

সঙ্কটকালে রাজনীতি তাঁরা করছেন না, শাসক দল করছে। অভিযোগ দিলীপ ঘোষের। ছবি —দিলীপ ঘোষের ফেসবুক পেজ থেকে।

সঙ্কটকালে রাজনীতি তাঁরা করছেন না, শাসক দল করছে। অভিযোগ দিলীপ ঘোষের। ছবি —দিলীপ ঘোষের ফেসবুক পেজ থেকে।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২০ ১৮:০৪
Share: Save:

সঙ্কটের সময়ে রাজনীতি করার অভিযোগ আপনাদের বিরুদ্ধে কেন উঠছে? খোদ প্রধানমন্ত্রী মানে আপনাদের দলের হৃদয় সম্রাট, তিনি বলেছেন যে, এখন রাজনীতি করার সময় নয়। তবু, এ রাজ্যের বিজেপি নেতাদের রোজ সরব হতে দেখা যাচ্ছে। কেউ সাংবাদিক সম্মেলন করে রাজ্য সরকারকে গালিগালাজ করছেন। কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় নিরন্তর আক্রমণ করে যাচ্ছেন। কেন? প্রধানমন্ত্রীর বার্তাও কি আপনারা মানছেন না?

আমরা রাজনীতি করছি? প্রধানমন্ত্রীর বার্তা আমরা মানছি না? বলছেন কী ভাবে এ কথাটা!

আমরা বলছি না। আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে।

অভিযোগ কারা তুলছেন? যাঁরা নিজেরা রাজনীতি করছেন, অভিযোগ তাঁরাই তুলছেন। আমরা তো প্রধানমন্ত্রীর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছিলাম, লকডাউন ভেঙে নিজেরাও বেরচ্ছিলাম না, অন্যদেরও ঘরে থাকতে অনুরোধ করছিলাম। সবার আগে লকডাউন ভাঙলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে শুরু করলেন, বাজারে বাজারে ঘুরতে শুরু করলেন। তাঁর দেখাদেখি অন্য তৃণমূল নেতারাও নেমে পড়লেন। তার পরে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় আমাদের চ্যালেঞ্জ করলেন। কোথায় বিজেপি নেতারা, এই সঙ্কটের সময়ে তাঁদের দেখা যাচ্ছে না কেন, তাঁরা ঘরে বসে কেন? সুব্রতবাবু এই প্রশ্ন তুললেন। আর এত কিছুর পরে যদি আমরা গরিব মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি, সেটা রাজনীতি হয়ে গেল!

তা হলে সুব্রত মুখোপাধ্যায় চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন বলেই রাস্তায় নামলেন? সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে জবাব দেওয়াটাই মূল লক্ষ্য?

মূল লক্ষ্য সমস্যায় থাকা মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তৃণমূল বেশি কথা বলছে তো, আমরা রাজনীতি করছি বলে অভিযোগ তুলছে। তাই সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কথাগুলো মনে করিয়ে দিলাম। সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে রাজনীতিটা কারা করছেন, সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। দেখুন, আমরা রাজ্য সরকার তথা প্রশাসনের উপরে আস্থা রাখার চেষ্টাই করেছিলাম। কিন্তু তার পরে কী দেখলাম? রেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রেশন দোকান থেকে যাঁর যা প্রাপ্য, সরকার যা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে, তা দেওয়া হচ্ছে না। বেছে বেছে তৃণমূলের লোককে পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। তৃণমূল নেতারা চাল লুঠ করে দলের নামে বিলি করছেন। সুতরাং আমাদের রাস্তায় নামতেই হল। যাঁরা খাবার পাচ্ছেন না, ত্রাণ পাচ্ছেন না, তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হল।

আরও পড়ুন: পুলিশ লাইনের ছাদ থেকে চলছে এলোপাথাড়ি গুলি, আতঙ্ক ঝাড়গ্রামে

আপনারা সক্রিয় হওয়ার পরে কি সবাই ত্রাণ বা খাদ্যসামগ্রী পাচ্ছেন?

কী করে পাবেন? আমাদের কি কাজ করতে দিচ্ছে? অর্জুন সিংহকে রাস্তায় আটকে দেওয়া হচ্ছে, সব্যসাচী দত্তকে ত্রাণ বিলি করতে দেওয়া হচ্ছে না। জন বার্লা, জয়ন্ত রায়কে গৃহবন্দি করা হচ্ছে। সুকান্ত মজুমদারকে আজ আটকে দেওয়া হয়েছে। এটা কী ধরনের রাজনীতি! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ত্রাণ বিলি করছেন, ফিরহাদ হাকিম করছেন, এই মন্ত্রী করছেন, সেই সাংসদ করছেন, বিধায়করা করছেন। আর বিজেপির কেউ রাস্তায় বেরতে পারবেন না। এগুলো নিয়ে কথা বলা যাবে না? এগুলো নিয়ে কথা বললেই আমরা রাজনীতি করছি!

হ্যাঁ, আজও বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্ত মজুমদারকে পুলিশ আটকে দিয়েছে শুনলাম। অথচ গত কাল নাকি অর্পিতা ঘোষকে ওই এলাকাতেই অবাধে ঘুরতে দেওয়া হয়েছে।

সে কথাই তো আমরা বলছি! লকডাউনের দোহাই দিয়ে অন্য সবাইকে আটকে রাখা হবে, আর তৃণমূলের নেতারা অবাধে ঘুরে বেড়াবেন, এটা আবার কোন দেশের নিয়ম? তা-ও যদি বুঝতাম সবাই রেশন এবং ত্রাণ ঠিকঠাক পাচ্ছেন, তা হলে এত কথা বলার দরকার পড়ত না। কিন্তু এত অমানবিক এরা যে, এই সঙ্কটের সময়েও লুঠপাট চালাচ্ছে। এ কথাগুলো আমরা না বললে কে বলবে?

আচ্ছা, তা হলে কি বলতে চাইছেন যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঠিক মতো পরিস্থতির মোকাবিলা করছে না?

সে কথা কি আমাদের বলার প্রয়োজন রয়েছে? রোগের তথ্য লুকানো হচ্ছে, গোপনে মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে, মানুষ রেশন না পেয়ে রাস্তায় নামছেন। বাঁকুড়ায় গোপনে মৃতদেহ পোড়াতে গিয়ে পুলিশ মার খেয়েছে। আলিপুরদুয়ারে গিয়েছিল রাতের অন্ধকারে মৃতদেহ পুঁতে দিতে, সেখানেও গোলমাল হয়েছে। বাদুড়িয়ায় রেশন না পেয়ে মানুষ রাস্তা অবরোধ করেছে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। আমরা দেখেছি, পুলিশ কী ভাবে মারছে মহিলাদের। খাবার চেয়ে রাস্তায় নেমেছেন তিনি, পুলিশ পাঠিয়ে তাঁকে মারা হচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর অমানবিক দৃশ্য! এর পরেও আমরা বলে দেব আর তার পরে আপনারা বুঝবেন যে, পরিস্থিতি এখানে ঠিক নেই!

রাজ্যে রেশন ব্যবস্থা ঠিক মতো কাজ করছে না বলেই ত্রাণ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে রাস্তায় নামতে হচ্ছে বলে দিলীপ ঘোষের দাবি। ছবি —দিলীপ ঘোষের ফেসবুক পেজ থেকে।

করোনা সংক্রান্ত তথ্য গোপন করা হচ্ছে, এই কথাটাও আপনারা বার বার বলছেন। এর কোনও প্রমাণ রয়েছে কি? নাকি বলতে হয়, তাই বলে যাচ্ছেন?

তথ্য যদি গোপন না-ই করা হবে, তা হলে রাতের অন্ধকারে মৃতদেহের সৎকার করতে যেতে হচ্ছে কেন? হুগলি থেকে আজই আমার কাছে একটা ভিডিয়ো এসেছে, একটা মেয়ে কাঁদছে সেই ভিডিয়োয়। সে জানাচ্ছে, তাঁর মায়ের করোনা হয়েছিল, তাঁকে বাড়ি থেকে নিয়ে চলে গিয়েছিল প্রশাসন, আর গোটা পরিবারকে কোয়রান্টিনে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তার পরে ওই মেয়েটির মা মারা গিয়েছেন। পরিবার শেষ বারের জন্য মৃতদেহটাও দেখতে পায়নি। কোথায় সৎকার হল, কী হল, কেউ জানেন না। এর পরে মেয়েটির বাবাকেও অন্য কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোথায় তিনি রয়েছেন, কোন হাসপাতালে, কেমন আছেন এখন, পরিবার কিচ্ছু জানে না। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলছে, বাবাকে আর কখনও দেখতে পাবে কি না জানে না। এগুলো কী! এই ভাবে করোনার মোকাবিলা হচ্ছে? পরিবারের লোককেও সঠিক তথ্য জানতে দেওয়া হচ্ছে না!

আরও পড়ুন: জম্মু-কাশ্মীরে করোনা-আক্রান্তদের ঢোকানোর চেষ্টা করছে পাকিস্তান, দাবি পুলিশ প্রধানের

কেন্দ্রীয় দল নিয়েও প্রথম দু’দিন খুব চাপানউতোর চলল দেখলাম। কিন্তু রাজ্য সরকার সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়ার পরেও বুধবার দিনভর কেন্দ্রীয় দল কেন ঘরে বসে ছিল?

কেন্দ্রীয় দল কী পদ্ধতিতে কাজ করবে, সেটা কেন্দ্রীয় দলই জানে। সেটা নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আজ তো তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে শুরু করেছেন, আরও অনেক জায়গাতেই হয়তো ঘুরবেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় দলকে বাধা দেওয়া হল কেন? সেই প্রশ্নটার উত্তর আগে খুঁজুন। অন্য কয়েকটা রাজ্যেও তো কেন্দ্রীয় দল পাঠানো হয়েছে। কোথাও তো তাঁদের বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি, কোথাও তো তাঁদের আটকানোর চেষ্টা হয়নি। যত সমস্যা সব এই পশ্চিমবঙ্গে কেন? কী লুকিয়ে রাখতে চাইছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী?

আপনাদের কী মনে হয়? কেন কেন্দ্রীয় দলকে নিয়ে সমস্যা হল?

বলছি তো, রাজ্য সরকার তথ্য লুকোতে চাইছে, তাই সমস্যা হয়েছে। কেন্দ্রীয় দল এসেছে, তাঁরা অনেক কিছু খতিয়ে দেখবেন। লকডাউন ঠিক মতো মানা হচ্ছে কি না, স্বাস্থ্য দফতর কী ভাবে কাজ করছে, কোয়রান্টিন সেন্টারগুলোর পরিকাঠামো কেমন, টেস্টিং কেমন হচ্ছে, আক্রান্ত কত, মৃত কত, হাসাপাতালগুলোয় চিকিৎসার মান কেমন, মানুষ ঠিক মতো খাবার ও ত্রাণ সামগ্রী পাচ্ছে কি না— এমন অনেক কিছু খতিয়ে দেখে কেন্দ্রকে তাঁরা রিপোর্ট দেবেন। আর কেন্দ্র রিপোর্ট পেলেই আসল তথ্যটা সকলের সামনে এসে যাবে, কিছু আর লুকিয়ে রাখা যাবে না। তাই বাধা দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে টেস্টিং করানো হচ্ছে না, সেই কারণেই কেন্দ্রীয় দলকে বাধা দেওয়া।

টেস্টিং তো অনেক বাড়ানো হয়েছে আগের চেয়ে। রাজ্য সরকার বা তৃণমূল তো বার বারই বলছে যে, আইসিএমআর যখন যেমন নির্দেশিকা পাঠিয়েছে, তখন তেমন ভাবে টেস্টিং হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে টেস্টিং-এর গড় তা হলে জাতীয় গড়ের চেয়ে কম কেন? আইসিএমআর-এর নির্দেশিকা তো আলাদা আলাদা নয়, গোটা দেশের জন্যই একই তো। তা হলে এখানে টেস্টিং-এর গড় কম কেন?

কেন কম? আপনার কী মনে হয়?

লুকোতে চাওয়া হচ্ছে। জাতীয় গড় অনুযায়ী, যত টেস্টিং হচ্ছে, তার সাড়ে ৪ শতাংশ পজিটিভ আসছে। পশ্চিমবঙ্গে যত টেস্টিং হচ্ছে, তার ৫.৮ শতাংশ পজিটিভ আসছে। জাতীয় গড়ের চেয়ে যে এখানে সংক্রমণ বেশি, সেটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লুকিয়ে রাখতে চাইছেন। লুকিয়ে রেখে যে বিপদ আরও বাড়বে, সেটা বলেও বোঝানো যাচ্ছে না। ওঁর বোধ হয় মনে হচ্ছে, সবাই ওঁকে দোষ দেবেন। দোষ দেওয়ার তো কিছু নেই। সারা পৃথিবীতেই রোগটা ছড়িয়েছে। কেউ ঠেকাতে পারছে না। উন্নত দেশগুলোও ঠেকাতে পারছে না। তা হলে পশ্চিমবঙ্গে ছড়ালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে সবাই দোষ দেবেন, এমনটা ভাবার তো কোনও কারণ ছিল না।

আরও পড়ুন: করোনার আগে আর এখন, একই জায়গার দুই বিপরীত ছবি হতবাক করে দেবে

শেষ প্রশ্ন। রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় ক্রমশ সুর চড়াচ্ছেন। একটা টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে ‘অপরাধমূলক শাসন’ চলছে। আপনিও কি তাই মনে করেন?

রাজ্যপাল কোন প্রসঙ্গে বলেছেন, কোন তথ্যের ভিত্তিতে বলেছেন, আমি তো জানি না। রাজ্যপালের মন্তব্যের ব্যাপারে আমি কোনও মন্তব্য করব না। কিন্তু রাজ্যপালকে আজ মুখ খুলতে হচ্ছে কেন? খুলতে হচ্ছে, তার কারণ অন্য কাউকে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। সাধারণ মানুষকে মুখ খুলতে দেওয়া হচ্ছে না। মিডিয়ার গলা টিপে ধরা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কাউকে না কাউকে তো কথাগুলো বলতেই হবে। তাই রাজ্যপাল বলছেন। আমি রাজ্যপালের ভূমিকাকে সমর্থনই করছি। রাজ্য সরকার যখন কেন্দ্রীয় দলকে কাজ করতে দিতে চাইছে না, তখন রাজ্যপাল যেন সক্রিয় হন— এই অনুরোধ করে আমি তাঁকে চিঠিও লিখেছিলাম। রাজ্যপালের ভূমিকা প্রশংসনীয়। কিন্তু তিনি মুখ খুললেই তাঁকে ‘বিজেপির মুখপাত্র’ বলে আক্রমণ করা হচ্ছে। আগের রাজ্যপালকেও তাই বলা হত, এখনও সেই একই কথা বলা হচ্ছে। আসলে এ রাজ্য সত্যি কথা কেউ বললেই তিনি এখন ‘বিজেপির মুখপাত্র’ হয়ে যাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE