শুধু জোর চাই। পকেটের জোর। এবং যথেষ্ট জোর। তা হলেই আপনার ছেলে বা মেয়ের জন্য ডাক্তারির সিট বাঁধা। জয়েন্ট বা নিট-এর র্যাঙ্ক তলানিতে থাকলেও!
দালালচক্রের এমনই দাবি। এ বছর নিট ও রাজ্য মেডিক্যাল জয়েন্টের ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তারা বিভিন্ন অভিভাবককে লাগাতার ফোন, এসএমএস করে চলেছে। জানাচ্ছে, ঠিকঠাক দক্ষিণা দিলে পশ্চিমবঙ্গ বা ভিন রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়, নিট-জয়েন্টের র্যাঙ্ক যা-ই হোক। এমনকী, র্যাঙ্ক আদৌ না-এলেও তা সম্ভব বলে টোপ দিচ্ছে কেউ কেউ। কী রকম?
একাধিক অভিভাবক জানিয়েছেন, জনৈক শ্যামল দাস তাঁদের ফোনে বলেছেন, জয়েন্টের রেজাল্টের আগে যোগাযোগ হলে সহজেই সরকারি কলেজে হয়ে যেত। এখন শুধু বেসরকারিতে হবে। অভিভাবক সেজে তাঁকে ফোন করে বলা হল, একমাত্র সন্তানের নিট-র্যাঙ্ক খুব খারাপ। কোনও আশা আছে?
‘‘কেন থাকবে না? বলুন, কোথায় চান?’’— তুরন্ত জবাব শ্যামলবাবুর। কলকাতার কেপিসি থেকে শুরু করে হলদিয়ার আইকেয়ার ডেন্টাল বা দুর্গাপুরের গৌরীদেবী— সর্বত্র তাঁর হাত রয়েছে বলে দাবি করে তিনি জানিয়ে রাখলেন, কেপিসি-তে কম করে ষাট লাখ টাকা লাগবে। হলদিয়ায় বাহান্ন-তিপান্ন। গৌরীদেবীতে একটু কম। কিন্তু সে টাকা তো কলেজ নেবে! আপনার পারিশ্রমিক কত?
শ্যামলবাবুর উত্তর, ‘‘দেশের যে কোনও মেডিক্যাল কলেজের জন্য আমার সার্ভিস চার্জ দু’লাখ।’’
এক ঘাট থেকে আর এক ঘাটে। অভিভাবকের পরিচয়ে পরের ফোন ‘এডুকেশন ওয়ার্ল্ড’-কে। ভর্তি-সংস্থাটির প্রতিনিধি জানালেন, এ বছর কেপিসি-তে পারবেন না। হলদিয়া বা গৌরীদেবীতে পারবেন। র্যাঙ্ক দু’লাখ হলেও কুছ পরোয়া নেই। খরচ যথাক্রমে ৭৩ আর ৭২ লাখ। সার্ভিস চার্জ কত, ফোনে জানালেন না। ভরসাদায়ী গলায় বললেন, ‘‘চলে আসুন না এক দিন। সামনাসামনি কথা হবে।’’
তবে সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছে উইন কেরিয়ার প্রাইভেট লিমিটেড। তাদের ঘোষণা— নিটে র্যাঙ্ক না-করলেও কিচ্ছুটি এসে-যায় না। দেশের ‘টপমোস্ট’ কলেজগুলোয় ভর্তি পাকা। পুরো ‘প্যাকেজ’ অন্তত আশি লাখ। সঙ্গে সার্ভিস চার্জ— এমবিবিএসে পঞ্চাশ হাজার, বিডিএসে পঁচিশ। ফোনে সংস্থার প্রতিনিধির দাবি: এ বছর তাঁরা সারা দেশে বহু পড়ুয়াকে ভর্তি করিয়েছেন।
ভিন রাজ্যের চক্রও সক্রিয়। এখানকার অভিভাবকদের কাছে অহরহ তাদের ফোন, এসএমএস পৌঁছচ্ছে। মুম্বইয়ের ‘কাইন্ড অ্যাডভাইস ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড তেমনই একটি। ফোনে ধরা হলে সংস্থার প্রতিনিধি বেঙ্গালুরুর ছ’সাতটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের নাম করে জানালেন, কোর্স ফি পৌনে ছ’লাখ টাকা। ক্যাপিটেশন ফি ৩৬ লাখ। খরচের ২৫% কোম্পানি নেবে, চেকে। বাকিটা নগদে। ‘‘কোনও ঝক্কি নেই। বিলকুল সাদা কাজ।’’— আশ্বাস দিলেন বক্তা।
দেখে-শুনে স্বাস্থ্য দফতরের একাংশের পর্যবেক্ষণ: চাহিদা আছে বলেই দালালচক্রের এ হেন রমরমা। এদের ‘পরিষেবা’ গ্রহণকারী অভিভাবকের সংখ্যাও নগণ্য নয়। যাঁদের অধিকাংশের বক্তব্য— সন্তানকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন সফল করতেই তাঁরা জীবনভরের সঞ্চয় বাজি রাখতে পিছপা হচ্ছেন না।
এমতাবস্থায় প্রমাদ গুনছেন প্রবীণ শিক্ষক-চিকিৎসকেরা। ওঁদের প্রশ্ন— ‘‘এ ভাবে যারা ভর্তি হচ্ছে, তাদের সিংহভাগ নিম্ন মেধার। তারা কেমন ডাক্তার হবে?’’ এক সরকারি চিকিৎসকের কটাক্ষ, ‘‘বিচিত্র নয় যে, বিপুল খরচ পুষিয়ে নেওয়ার তাগিদে এদের অনেকে ডাক্তার হয়ে রোগীর ঘাড়ে কোপ বসাতে চাইবে! তাতে আমজনতারই সমূহ বিপদ।’’
যেখানে যেখানে ভর্তি করানোর প্রতিশ্রুতি মিলছে, সংশ্লিষ্ট সেই বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো অবশ্য দায়িত্ব নিচ্ছে না। হলদিয়া আইকেয়ার ডেন্টাল এবং গৌরীদেবী হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দাবি, তাদের নাম অনেকে ব্যবহার করলেও তারা হুঁশিয়ার। আর কেপিসি-র সর্বোচ্চ কর্ণধার কালীপ্রদীপ চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘দালাল-চক্রের উৎপাত বেশ ক’বছর ধরে চলছে। আমরা নাজেহাল। পুলিশে নালিশ করেছি। কলেজের প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে বলেছি। আমাদের কাছে ওরা বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় পায় না।’’
বস্তুত সাম্প্রতিক কেপিসি-বিতর্কের সূত্রে ‘দালালরাজের’ই প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন কালীপ্রদীপবাবু। তাঁর অভিযোগ— ভর্তি প্রক্রিয়ার প্রশ্নে সম্প্রতি যাঁরা কেপিসি’র বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছেন, দালালচক্রই তাঁদের ইন্ধন জোগাচ্ছে। ‘‘কারণ, দালালেরা নিজেরা সুবিধে করতে না-পেরে এখন চাইছে যে কোনও উপায়ে আমাদের কলেজে ভর্তি ভন্ডুল করে দিতে।’’— বলছেন তিনি। কেপিসি-কর্ণধারের দাবি, বিভিন্ন সময়ে তাঁদের দুর্নাম করার চেষ্টা হলেও তাঁরা নিজেদের মতো করে কলেজের মানোন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও মামলাকারী অভিভাবকদের মঞ্চ ‘কেপিসি ফাইটার্স’-এর পাল্টা দাবি, বেগতিক বুঝে কেপিসি মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষই ন্যায্য প্রতিবাদের গায়ে কালি ছেটাতে চাইছেন।
দালালরাজ রোখা যায় না?
কার্যত অসহায়তার সুর বাজছে স্বাস্থ্যকর্তাদের গলায়। সমস্যার কথা মেনেও রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘এ বছর এত রকম জট কাটাতে হল যে, সব দিকে নজর দেওয়া যায়নি। চরম অরাজকতা! অথচ আমাদের ক্ষমতা সীমিত। এ বছর কিছু করতে পারব না।’’ এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘সর্ষের মধ্যেই তো ভূত! না-হলে গার্জেনদের ফোন নম্বর ওরা পাচ্ছে কী ভাবে?’’
ভূত তাড়াতে যে মোক্ষম ঝাড়ফুঁক দরকার, কর্তারা তা মানেন। কিন্তু ওঝা কখন মিলবে, তা কারও জানা নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy