Advertisement
E-Paper

নোটের এক ঘায়ে বন্ধ ঠুকঠাক, কাজ হারিয়ে বাড়ি ফিরছেন স্বর্ণকারেরা

স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে মুম্বই শহরতলির দহিসরে এক চিলতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন বিমল সামন্ত। তাঁর ভাড়ার খুপচি দোকানঘরে সোনার কাজ করতেন পাঁচ জন কারিগর। তাঁদের মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা করে বেতন গুনেও বিমলের হাতে থাকত হাজার তিরিশেক টাকা।

অভিজিৎ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০২:৫৯
বাদলচন্দ্র পাল, মোহনচন্দ্র দাস ও বিমল সামন্ত

বাদলচন্দ্র পাল, মোহনচন্দ্র দাস ও বিমল সামন্ত

স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে মুম্বই শহরতলির দহিসরে এক চিলতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন বিমল সামন্ত। তাঁর ভাড়ার খুপচি দোকানঘরে সোনার কাজ করতেন পাঁচ জন কারিগর। তাঁদের মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা করে বেতন গুনেও বিমলের হাতে থাকত হাজার তিরিশেক টাকা।

সম্প্রতি সপরিবার ঠিকানা বদলছেন বিমল। ফিরেছেন ঘাটালের চাউলি গ্রামে বাপ-ঠাকুরদার ভিটেয়।

২৬ বছর ধরে দিল্লির করোলবাগে ছিলেন বাদলচন্দ্র পাল। নিজে দোকান খুলে জনা দশেক কারিগরকে নিয়ে সোনার কাজ করতেন। মাসে আয় ছিল ৩৫ হাজার টাকার মতো। দুই ছেলে-মেয়েকে দিল্লির স্কুলেই ভর্তি করেছিলেন। সদ্য দাসপুরের মাগুরিয়া গ্রামের বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ফিরে এসেছেন বাদলবাবুও।

পুজো-পার্বণের আনন্দে নয়, পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমা জুড়ে এখন নোটের চোটে ঘরে ফেরার ঢল। পেটের দায়েই এই উলটপুরাণ, বলছেন বিমল-বাদলেরা।

নোট বাতিলের প্রভাব খতিয়ে দেখতে রাজ্যে রাজ্যে আমলাদের দল পাঠিয়েছিল কেন্দ্র। সরেজমিন দেখে তাঁরা দিল্লিতে যে রিপোর্ট জমা করেছেন, তাতেও বলা হয়েছে— কাজের খোঁজে পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি থেকে যাঁরা উত্তর বা পশ্চিম ভারতে পাড়ি দিয়েছিলেন, তাঁরা এখন কাজ হারিয়ে ঘরে ফিরছেন। এই ‘রিভার্স মাইগ্রেশন’-এর জেরেই ঘাটাল, দাসপুরের গ্রামীণ অর্থনীতি এখন অনেকটাই নড়বড়ে।

ঘাটাল, দাসপুরের গ্রামগুলি থেকে অনেকেই রুজির টানে ভিন্‌ রাজ্যে পাড়ি দেন। এদের একটা বড় অংশ সোনার কারিগর। দিল্লি, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, পঞ্জাবের সোনাপট্টিতে কাজ করে সংসার চালান তাঁরা। তাঁদের পাঠানো টাকার উপর অনেকটাই নির্ভর করে রয়েছে এই এলাকার অর্থনীতি। নোট বাতিলের ধাক্কায় আতান্তরে শুধু এই সোনার কারিগরদের পরিবারগুলি নয়, বিপন্ন তাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা কারবারও। এই সব কারিগরের অনেকেই ভিন্‌ রাজ্যের আস্তানা গুটিয়ে সদলবলে গ্রামে ফিরেছেন। আর যাঁরা রয়ে গিয়েছেন, হাতে টাকা ফুরিয়ে যাওয়ায় তাঁদের অবস্থাও রীতিমতো সঙ্গীন। দিল্লির ‘স্বর্ণকার সেবাসঙ্ঘ’-এর আহ্বায়ক কার্তিক ভৌমিক মঙ্গলবার ফোনে বললেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার ছেলে এখানে সোনার কাজ করে। প্রায় সকলেই চলে যাচ্ছে।’সোনার বাজারে ধাক্কাটা এসেছিল ‘ব্রেক্সিট’-এর পরেই। গণভোটের রায়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেন সরে দাঁড়ানোর সময়ই এ দেশের সোনার কারবারে চোট লেগেছিল। স্বর্ণশিল্পে উৎপাদন শুল্ক বাড়ায় এবং কাঁচা সোনা লেনদেনে নানা বিধিনিষেধ চালু হওয়ায় তরতর করে চড়েছিল সোনার দাম। এতে মার খেয়েছিল গয়নাশিল্প। সেই অবস্থা থিতু হতে না হতেই নোট বাতিলের ঘা। বছর কুড়ি আগে ঘাটাল থেকে মুম্বইয়ে পাড়ি জমানো বছর আটত্রিশের বিমল বলছিলেন, “বড় বড় সোনার দোকানের মালিকরা আমাদের গয়না তৈরির বরাত দিতেন। পাঁচশো-হাজারের নোট বাতিল হতেই কাজের বরাত আসা একদম বন্ধ হয়ে গেল। বৌ-বাচ্চা নিয়ে আর চালানো সম্ভব হচ্ছিল না।’’ গত ২৩ নভেম্বর তাই সঙ্গী পাঁচ কারিগরকে নিয়েই ফিরে এসেছেন বিমল। তাঁর কথায়, ‘‘ক’দিন আগেও একশো গ্রাম সোনার কাজ করলে আয় হতো দেড় হাজার টাকা। নিমেষে সব শেষ হয়ে গেল।’’

দিশাহারা দাসপুরের জোত ঘনশ্যামপুরের বাসিন্দা বছর পঁয়ত্রিশের মোহনচন্দ্র দাসও। ষোলো বছরে বাড়ি ছেড়ে পড়শি দাদা হৃদয় পোড়ের সোনার দোকানে কাজ শিখতে দিল্লির করোলবাগে গিয়েছিলেন তিনি। সদ্য সেখানে নিজের দোকান খুলেছিলেন মোহন। গত ২ ডিসেম্বর সেই দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে গ্রামে ফিরে এসেছেন তিনি। তাঁর কথায়, “দু’জন কারিগর নিয়ে বেশ কাজ করছিলাম। মাসে হাজার কুড়ি আয় হচ্ছিল। স্ত্রী ও দুই ছেলে গ্রামের বাড়িতেই থাকত। ভেবেছিলাম ওদেরও দিল্লি নিয়ে যাব। সরকারের একটা সিদ্ধান্ত সব তছনছ করে দিল।’’

দাসপুরের সীতাপুরের মদন মাইতি, চাঁইপাটের শ্যামপদ সামন্ত, সাতপোতার পঞ্চানন দাসরা এখন হন্যে হয়ে বিকল্প কাজ খুঁজছেন। সোনার গয়নায় কাজ তোলা হাতগুলো পেটের দায়ে জমি চষছে বা রাজমিস্ত্রির কাজ করছে। কেউ খুঁজছেন পেট চালানোর মতো যা হোক একটা কাজ।

কিন্তু কাজ আসবে কোত্থেকে! দাসপুর ২ পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ আশিস হুতাইত জানালেন, দাসপুরের দু’টি ব্লক মিলে ৪৫ হাজার পরিবারের প্রায় প্রতিটিরই কেউ না কেউ ভিন্‌ রাজ্যে সোনার কারিগরের কাজ করেন। আশিসবাবুর কথায়, ‘কয়েক হাজার ছেলে ফিরে এসেছে। এখানে তো কোনও কাজই নেই!’’

Demonetisation Worker
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy